ডিপ স্টেট: মঞ্চের পেছনের কুশীলব
ইদানীং আমরা প্রায়শই ‘ডিপ স্টেট’ বলে একটি কথা শুনি। টার্মটি অতিসাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। শুনলেই কেমন যেন একটা অজানা ভয়, আতঙ্ক কাজ করে। সবার মধ্যেই মোটাদাগে একটা সাধারণ ধারণা আছে যে ডিপ স্টেট হল সরকারের ভেতরে একটি অদৃশ্য সরকার, যারা রাষ্ট্রের হয়ে গোপনে একযোগে কাজ করেন। কেউ একে বলেন অদৃশ্য সরকার, কেউ বলেন গোপন সরকার, কেউ বলেন ছায়া সরকার। ডিপ স্টেট শব্দটির উৎপত্তি তুর্কি ভাষায় ‘ডেরিন ডেভলেট’ থেকে। বিশেষ করে শীতল যুদ্ধের সময়ে সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্রের প্রভাবকে কেন্দ্র করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ডিপ স্টেট টার্মটি আলোচনায় আসে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের মাধ্যমে।
তারা অভিযোগ করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কিছু পেশাদার কূটনীতিক অনুসারী রাষ্ট্রের গোপন নথি গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন। ট্রাম্প এবং তার দলের নীতি নির্ধারকরা অভিযোগ করেন, ডিপ স্টেট তার রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালায় হস্তক্ষেপ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসও এই ডিপ স্টেটের অংশ হিসাবে কাজ করছে! রিপাবলিকানরা আবার এই ডিপ স্টেট টার্মটি নিয়েছিল ২০১৬ সালে মাইক লফরেন নামের একজন রিপাবলিকান কংগ্রেশনাল স্টাফের লেখা বই ‘ দি ডিপ স্টেট: দি ফল অব দ্য কনস্টিটিউশন অ্যান্ড দ্য রাইজ অফ এ শ্যাডো গভর্নমেন্ট’ থেকে। লফরেনের মতে, সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মচারী, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে ডিপ স্টেট কাজ করে থাকে।
সরকারের নানা দায়িত্বে থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের স্বার্থে অদৃশ্য শক্তির কাজ করা নতুন কিছু না। শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, রাশিয়া, ব্রিটেন, চিন, তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইসরায়েল, মিশরসহ সারা বিশ্বেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশে ডিপ স্টেটের অস্তিত্ব রয়েছে। মজার ব্যাপার হল, সাধারণ মানুষের মধ্যে ডিপ স্টেট টার্মটি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ব্যবহৃত হয় অন্যান্য দেশে এবং তা যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে। তার একটি কারণ আছে। চরিত্রগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের ডিপ স্টেটের একটি বেসিক পার্থক্য আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেট যতটা না দেশের অভ্যন্তরে, তার চেয়ে বেশি সক্রিয় বাইরের দেশগুলিতে। আর অন্য অনেক দেশে ডিপ স্টেট অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের দমন, বিদ্রোহ-আন্দোলন দমনের ব্যাপারে অধিক সক্রিয়। এবং এইসব দেশে ‘সরকারের ভেতরে সরকার’ যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই নেটওয়ার্ক বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে থাকে বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য। তাই, ডিপ স্টেটের কর্মকাণ্ড কীভাবে হয়, কর্ম পদ্ধতি কী তার আদ্যোপান্ত আমরা যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ থেকেই দেখতে পারি।
যুক্তরাষ্ট্রের এই ডিপ স্টেটের কেন্দ্রবিন্দু হল সিআইএ। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে দেশটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, আর্মি ইন্টেলিজেন্স, নেভি ইন্টেলিজেন্স, এয়ারফোর্স ইন্টেলিজেন্স, দি স্টেট ডিপার্টমেন্ট ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ, অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশন এবং ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই। এগুলো সবই সরকারের প্রতিষ্ঠান। এটি একটি নেটওয়ার্ক যেখানে বাছাই করা লোকেরা থাকেন এবং কোন দল ক্ষমতায় সেটা তাদের বিষয় নয়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে না। এই নেটওয়ার্ক প্রয়োজনমাফিক নানা সংগঠন, নানা ব্যক্তি, সেলিব্রিটি, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়িদের ব্যবহার করে থাকে। কাউকে একটি নির্দিষ্ট অ্যাসাইনমেন্ট সঙ্গে রাখে, আবার কাউকে দীর্ঘমেয়াদে নিয়োজিত রাখে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম নীতি হচ্ছে জো বাইডেন বিশ্বব্যাপী যা করেছেন তার উল্টোটা করা। অনেকটা বাংলাদেশের বিগত দিনের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মত। কিন্তু ডিপ স্টেট তথ্য, তত্ত্ব ও ধারণা দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরিয়ে রাখছে। অর্থাৎ সরকার অনেকটাই ডিপ স্টেটের কাছে নিরুপায়। সুতরাং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকার হল মঞ্চের অভিনেতার মত। পেছনে গ্রিন রুম থেকে শাহজাদা সাজিয়ে মঞ্চে পাঠাচ্ছে এই ডিপ স্টেটের কলাকুশলীরা।
আরো কী করে জানেন? বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান, আইএমএফ, বিশ^ব্যাংক, সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের নামি-দামি ব্যাংকগুলোতে তাদের প্রতিনিধি বা এজেন্ট বসিয়ে রাখে। অথবা ওইসব ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। এতে সারা বিশ্বের ক্ষমতাশালী লোকদের সব খবর ডিপ স্টেটের জানা থাকে এবং প্রয়োজনে সেই তথ্য ব্যবহার করা হয়, ব্ল্যাকমেইল করা হয়। বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি নিয়ন্ত্রণ রাখে তারা। বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। এবং সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক ব্যাপার হল, তারা বহু দেশের বিচার বিভাগের শীর্ষ বিচারকদের, অ্যাটর্নি জেনারেলদের ব্যবহার করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অদৃশ্য সরকার সারা বিশ্বব্যাপী গোপন তথ্য সংগ্রহ করে, গোয়েন্দা অভিযান পরিকল্পনা এবং গোপনে অপারেশন চালায়। এই অপারেশন আবার নানা ধরনের হয়ে থাকে। কখনো নিজেরা, কখনো কোনো দেশের জনগণের মধ্যে সেন্টিমেন্ট তৈরির মাধ্যমে, আবার কখনো একটি দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রবেশ করে সেই সেনাবাহিনী দিয়ে হত্যা, ক্ষমতার বদল।
এই অদৃশ্য সরকার নিজ দেশের সরকারকেও ক্ষেত্রবিশেষ নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়ায়। কোনো ক্ষেত্রে ভুল ইনফরমেশন দিয়ে, কোনো ক্ষেত্রে ইনফরমেশন সরকারের কাছে গোপন রেখে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং সেই সময় থেকেই এই ডিপ স্টেটের তৎপরতা জোরালোভাবে শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট জর্জ সি. মার্শাল জুনিয়র কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় যান নবম ইন্টার-আমেরিকান কনফারেন্সে যোগ দিতে। বোগোটায় তখন অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতা এবং প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এলিসার গাইতানকে রাস্তায় হত্যা করা হয়।
এই হকত্যাকাণ্ড নিয়ে বোগোটটায় ভয়ানক সহিংসতা শুরু হয়। সেক্রেটারি অব স্টেট মার্শাল ভীষণ বিব্রত হন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট জানিয়েছিল, এই সহিংসতা সম্পর্কে সিআইএ কিছুই জানায়নি। অথচ এলিসারের হত্যাকাণ্ডের পেছনে সিআইএ’র হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তৎকালীন কলম্বিয়ার সরকার এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা ছিল। অথচ ডিপ স্টেট সরকারের অনুমোদন ছাড়াই বা অজ্ঞাতসারে কলম্বিয়ার বিরোধী দলের নেতাকে হত্যা করে।
১৯৬২ সালে সিআইএ তথা ডিপ স্টেট দুইজন এজেন্টকে চিনে একটি প্লেন থেকে অবতরণ করায়। সেই এজেন্টরা ধরা পড়ে এবং চিনে তারা কারাবরণ করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানে যে ওরা দুজন সিভিলিয়ান, কোরিয়া থেকে জাপান যাওয়ার পথে তাদের বিমান হারিয়ে যায় এবং চিনের হাতে ধরা পড়ে। ১৯৫৩ সালে ইরানে শাহ’র মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী নেতা মোসাদ্দেগকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ইরানের রানী সুরাইয়া তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সোয়ার্জকফ নামে একজন আমেরিকান তৎকালীন আমলে ৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করেন শাহ’র পেছনে।
১৯৫৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট জন ফস্টার দুলেস মিশর সফর করেন। তিনি মিশরে পৌঁছানোর আগেই সিআইএর একজন সহকারী পরিচালক প্রেসিডেন্ট নাসেরের সঙ্গে দেখা করে সেক্রেটারি দুলেসের নামেই একটি অফিসিয়াল চিঠি ধরিয়ে দেন। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, মি. নাসের যেন কোনোক্রমেই কমিউনিস্টদের কাছ থেকে অস্ত্র না ক্রয় করেন, এটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধ। অথচ ওই চিঠি সম্পর্কে দুলেস কিছুই জানতেন না!
এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে যেসব তথ্য স্মৃতিচারণ, আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে উঠে এসেছে। এছাড়াও আমরা আধুনিক সময়ের মানুষ হিসাবে ইন্টারনেটের সুবাদে নানা কিছু ঠাওর করতে পারি। তারই একটি উদাহরণ দিয়ে লেখা শেষ করি। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছেন না, ইউক্রেনকে ভারী ভারী অস্ত্র সরবরাহ করতে চাচ্ছেন না। তথাপি ট্রাম্পের মত শক্ত, জোরালো কণ্ঠের, খেপাটে প্রেসিডেন্টও ইউক্রেনকে সাহায্য করা থেকে সরে আসতে পারছেন না ওই ডিপ স্টেটের কারণে। ডিপ স্টেট ইউরোপের প্রতি নমনীয় এবং ইউরোপ চাচ্ছে যত ব্যয় হোক, যত ত্যাগ প্রয়োজন হোক, রাশিয়াকে পরাজিত করতে। তাতে ইউরোপ স্থায়ীভাবে নিরাপদ হবে এবং রাশিয়াকে ডোমিনেট করা যাবে। ডিপ স্টেট ইউরোপের এই ধারণা সঙ্গে একমত।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম নীতি হচ্ছে জো বাইডেন বিশ্বব্যাপী যা করেছেন তার উল্টোটা করা। অনেকটা বাংলাদেশের বিগত দিনের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মত। কিন্তু ডিপ স্টেট তথ্য, তত্ত্ব ও ধারণা দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরিয়ে রাখছে। অর্থাৎ সরকার অনেকটাই ডিপ স্টেটের কাছে নিরুপায়। সুতরাং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকার হল মঞ্চের অভিনেতার মত। পেছনে গ্রিন রুম থেকে শাহজাদা সাজিয়ে মঞ্চে পাঠাচ্ছে এই ডিপ স্টেটের কলাকুশলীরা।
লেখক : সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।
এইচআর/এমএস