মজলুমের দোয়া আল্লাহ দ্রুত গ্রহণ করেন

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১২:১৫ পিএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫

বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহপাক শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামকে শান্তির বার্তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। ইসলাম এমন একটি শান্তিপ্রিয় ধর্ম যেখানে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের স্থান নেই। ইসলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী, সবার সাথে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ থাকার শিক্ষা দেয়। ইসলাম আমাদেরকে এমন সুন্দর শিক্ষা দেয় যা পালনে সমাজ ও দেশ হয়ে উঠে শান্তিময়।

ইসলাম অমুসলিমদের উপাসনালয়ে কোনরূপ আক্রমণ চালানোকেও কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয়, বরং অমুসলিমরা যেসবের উপাসনা করে সেগুলোকে গালমন্দ করতেও আল্লাহপাক বারণ করেছেন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যাদের উপাস্যরূপে ডাকে, তোমরা তাদের গালমন্দ করো না। নতুবা তারা শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাহকেই গালমন্দ করবে।’ (সুরা আন আম, আয়াত: ১০৮)
এ আয়াতে শুধু প্রতিমা পূজারিদের সংবেদনশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দান করা হয়নি বরং সব জাতি এবং সব সম্প্রদায়ের মাঝে বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআন পাঠে আমরা দেখতে পাই, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যখন আদম সৃষ্টির মহা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন, তখন ফিরিশতাগণ আল্লাহতায়ালাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছ, যে সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে আর রক্তপাত ঘটাবে? এর উত্তরে সর্বজ্ঞানী খোদা কেবল এটাই বলেছিলেন, ‘ইন্নি আ’লামু মালা তা’লামুন’ অর্থাৎ আমি তা জানি, যা তোমরা জানো না’ (বায়হাকি)।

বাহ্যত দৃষ্টিতে মনে হবে, যেখানেই ধর্ম সেখানেই অশান্তি, যেখানেই ধর্ম সেখানেই বিগ্রহ ও নৈরাজ্য। কিন্তু না, একটু মনোযোগ দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে দেখুন। দেখতে পাবেন, এই বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ধার্মিকদের পক্ষ থেকে নয় আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সত্য ধর্মের অনুসারীদের পক্ষ থেকেও নয়। কিন্তু যারা সমাগত সত্য সুন্দর জ্যোতিকে অস্বীকার করে অন্ধকারের পূজারি হয়ে থাকতে চেয়েছে, যারা তাদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও গলিত মথিত সমাজ দর্শন পরিত্যাগ করতে চায়নি- এসব অরাজকতা ও সন্ত্রাস সব সময় সর্ব যুগে তাদের পক্ষ থেকে পরিচালিত হয়েছে।

হজরত আদম (আ.) থেকে আরম্ভ করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত ইতিহাসের এই একই ধারার পুনরাবৃত্তি আমরা লক্ষ্য করবো। বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনী সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে। তিনি সত্য প্রচার ও প্রসারের কারণে সারা জীবন কষ্ট করেছেন। মহানবির পবিত্র দেহ রক্তাক্ত হয়েছে, কতই না কষ্ট সহ্য করেছেন কিন্তু কারও প্রতি ধর্মের কারণে তিনি বলপ্রয়োগ করেননি। বরং তার পক্ষ থেকে পরিচালিত সব আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ ছিল সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য।

সমাজ ও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। যারা বিশৃঙ্খলা করে, সমাজের শান্তি নষ্ট করে তাদেরকে আল্লাহপাক ভালোবাসেন না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘তারা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, আল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৬৪)

সুরা হজের দুটি আয়াত এ বিষয়ে আমাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হলো : কেননা তারা অত্যাচারিত। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাহায্যকল্পে পূর্ণ ক্ষমতাবান। যাদেরকে তাদের নিজ বাড়িঘর থেকে অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে বের করে দেওয়া হয়েছে যে, তারা বলে, ‘আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক প্রভু! আল্লাহ’র পক্ষ থেকে যদি মানুষের একদলকে মানুষের আরেক দল দিয়ে প্রতিহত না করা হতো, তাহলে সাধু-সন্ন্যাসীদের মঠ, গির্জা, ইহুদীদের উপাসনালয় (ধ্বংস করে দেওয়া হতো) যেখানে আল্লাহ’র নাম অধিক পরিমাণে স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী।’ (সুরা আল হজ, আয়াত : ৩৯ ও ৪০)

মদিনায় অবতীর্ণ উল্লিখিত আয়াত দু’টিতে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীরা দীর্ঘকাল মক্কায় অত্যাচারিত নিপীড়িত থাকার পর যখন তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আবারও মক্কার কাফেররা যুদ্ধ চাপিয়ে দিল, কেবল তখনই আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করার অনুমতি আল্লাহপাক দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, একথা বলা হয়েছে, কেবল মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার্থে এই যুদ্ধ পরিচালিত হবে না। বরং মঠ, গির্জা, মন্দির ও মসজিদ তথা সকল ধর্মের উপাসনালয় রক্ষার্থে আল্লাহ এ ব্যবস্থা নিয়েছেন। সব ধর্মীয় ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার এর চেয়ে স্পষ্ট ঘোষণা আর কি হতে পারে? এ জন্যই ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম।

আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে কত সুন্দর শিক্ষা দিয়েছেন, মহানবি (সা.) কোনো মানুষ, জীবজন্তু বা কোনো ফসল-গাছপালাকে আগুনে পোড়াতে নিষেধ করেছেন। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘আগুন দ্বারা শুধু আল্লাহই শাস্তি দেবেন, আগুনের রব (আল্লাহ) ছাড়া আর কারও আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।’ (বুখারি)

আমরা হয়ত অনেকেই এটি জানি না, পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও ঘৃণিত কাজ হচ্ছে মানুষ হত্যা করা। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন কতই না মায়ের বুক খালি করা হচ্ছে। নিরীহ মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এসব অন্যায় কাজের শেষ কোথায়, তা কেবল আল্লাহপাকই ভালো জানেন।

মানুষ হত্যার বিষয়ে আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। তিনি (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি)
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এত কঠোর হুঁশিয়ারির বিষয়টি জানা সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য করি, সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে পরবর্তীতে তা হত্যা পর্যন্ত গড়ায়। আল্লাহপাক আমাদেরকে বিবেক বুদ্ধি দিন। কেননা, সমাজ জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য কর্তব্য এবং ঈমানি দায়িত্ব।

আরেকটি হাদিসে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না-
প্রথমত : ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া।
দ্বিতীয়ত : ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া।
তৃতীয়ত : মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব। (তিরমিজি)
সারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলাম নামের ধর্ম আল্লাহতায়ালা এই পৃথিবীতে বিশ্বনবি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে শান্তির অমিয় বাণী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন।

সমাজ ও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। যারা বিশৃঙ্খলা করে, সমাজের শান্তি নষ্ট করে তাদেরকে আল্লাহপাক ভালোবাসেন না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘তারা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, আল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৬৪)

আমরা যেন এমন কোনো কাজ না করি, যার ফলে আল্লাহপাক আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হোন। আমাদের দ্বারা যেন কেউ জুলুমের শিকার না হয়, কেননা মজলুমদের দোয়া আল্লাহতায়ালা দ্রুত গ্রহণ করে নেন।

যেভাবে হাদিসে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফের হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়ে যায়)।’ (মুসনাদে আহমদ)

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।