সুস্থ শহরের জন্য সুস্থ মাটি: টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি
মানুষের জীবনে মাটি যেন চিরন্তন এক নীরব সহচর। আমরা মাটির ওপর হাঁটি, দাঁড়াই, ঘর গড়ি, তবে খুব কম মানুষই জানে যে এই মাটি প্রকৃতপক্ষে জীবন্ত এক জগৎ। মাটির নিচে মিলেমিশে আছে কোটি কোটি অদৃশ্য জীবাণু, অণুজীব, শেকড়, পুষ্টি উপাদান এবং পানি, যা একত্রিত হয়ে তৈরি করে পৃথিবীর প্রাণভূমি। শহর যত আধুনিক এবং কংক্রিটে মোড়ানোই হোক না কেন, তার অস্তিত্বের ভিত্তি এখনও মাটির সুস্থতার উপর নির্ভরশীল।
দ্রুত নগরায়ণ, নির্মাণসামগ্রীর অতিরিক্ত ব্যবহার, প্লাস্টিক দূষণ, বর্জ্য স্তুপ এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামো আমাদের শহরের মাটিকে নীরবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই বাস্তবতার মধ্যে মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য প্রতি বছরের ৫ ডিসেম্বর পালিত হয় বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের লক্ষ্য হলো মৃত্তিকাসম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সংরক্ষণের ওপর সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রথমবার এই দিবসটি উদযাপিত হয় ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর। এটি শুরু হয় থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা আদুলিয়াদেজের স্মরণে। রাজা ১৯২৭ সালের ৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্তিকাসম্পদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এবং তার আন্তরিকতা, চিন্তা ও আবেগ দিয়ে সারা বিশ্বের মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাই তার জন্মবার্ষিকীর দিনেই প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বিশ্ব মৃক্তিকা দিবস-২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “সুস্থ শহরের জন্য সুস্থ মাটি” প্রথম দেখায় শুধু একটি স্লোগান মনে হতে পারে। তবে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে নগরজীবনের নিরাপত্তা, খাদ্য প্রাপ্যতা, পরিবেশগত টেকসইতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনের প্রশ্ন। শহরের পরিবেশ, তাপমাত্রা, বৃষ্টির পানির প্রবাহ, দূষণ, এমনকি মানুষের মানসিক সুস্থতাও মাটির গুণাগুণের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) জানাচ্ছে যে পৃথিবীর মোট আবাদযোগ্য জমির ৩৩ শতাংশ ইতোমধ্যে মাঝারি থেকে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার। যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৯০ শতাংশ মাটি অবক্ষয়প্রাপ্ত হবে। এই মাটির ধ্বংস শুধু গ্রামীণ এলাকায় নয়, শহরেও ভয়াবহ সংকট তৈরি করছে। শহর যত বাড়ছে, কংক্রিটের পরিমাণ তত বাড়ছে, সবুজের পরিমাণ তত কমছে এবং জীবন্ত মাটির স্থান তত সংকুচিত হচ্ছে। মাটির চারটি প্রধান উপাদান হলো খনিজ, জৈব পদার্থ, পানি এবং বায়ু। এর মধ্যে জৈব পদার্থ মাটির উর্বরতা রক্ষায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একটি উর্বর কৃষিজমির মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমপক্ষে ৫ শতাংশ থাকা উচিত। তবে বাংলাদেশে এটি গড়ে ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI) এবং অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, জৈব পদার্থের এই ঘাটতি শহরের মাটিকেও প্রভাবিত করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, প্লাস্টিকবর্জ্য, রাসায়নিক সার এবং অন্যান্য দূষণ নগরের মৃত্তিকাকে ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ করছে।
শহরের মাটি শুধু ফসল উৎপাদনের জন্য নয়, এটি নগরের পানির গুণমান, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, বায়ুর মান, সবুজ এলাকা এবং এমনকি মানুষের মানসিক শান্তি নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। মৃত্তিকায় বাস করা অণুজীব এবং জীবাণু নগরের জলবায়ু ভারসাম্য রাখতে, পানি পরিশোধন করতে, এবং উদ্ভিদের পুষ্টি শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন, পার্কে বা ছাদবাগানে খালি পায়ে হাঁটার সময় আমরা সরাসরি এই জীবন্ত মাটির শক্তি অনুভব করি। এটি মানসিক চাপ কমায়, ঘুমের মান উন্নত করে, শক্তি বৃদ্ধি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
বাংলাদেশে শহরের মাটির অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট এবং রাজশাহীতে নগরায়ণ খুব দ্রুত হয়েছে। প্রতিটি শহরের উর্বর জমি ভবন, রাস্তা, পার্কিং লট এবং শিল্প স্থাপনার নিচে চাপা পড়েছে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় মৃত্তিকা সিলিং। এর ফলে মাটি বৃষ্টির পানি শোষণ করতে পারে না, দূষণ পরিশোধন করতে পারে না, উদ্ভিদ ও অণুজীবের বাসস্থান হারায়। এই পরিবর্তনের পরিণতি স্পষ্ট: জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি, হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট, বায়ুদূষণ বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়।
বিশ্বব্যাপী শহরের ৭০ শতাংশ মানুষ ২০৫০ সালের মধ্যে শহরে বসবাস করবে বলে আশা করছেন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞগণ। বাংলাদেশেও নগরায়ণ দ্রুত বাড়ছে। ঢাকার মতো মহানগরে জলাবদ্ধতা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং ধূলিঝড়ের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পিএম ২.৫ ও পিএম-১০-এর বড় অংশ আসে খোলা মাটির ধূলিকণা থেকে। শহরের মাটি দূষিত হলে শুধু খাদ্য উৎপাদনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, মানসিক স্বাস্থ্য এবং নগরের পরিবেশও প্রভাবিত হয়।
গ্রামীণ এলাকায়ও মৃত্তিকার অবক্ষয় উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮১ লাখ হেক্টর জমিতে ৬৫.৫৩ লাখ মেট্রিক টন রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়েছে। এটি কৃষির ফলন বাড়ানোর জন্য হলেও মাটির উর্বরতা, অণুজীব এবং জলাধারণ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জৈব সার ব্যবহার কমে যাওয়ায় মাটির প্রাণশক্তি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে মাটির গুণাগুণ দ্রুত কমছে। ইউনেস্কোর ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, বিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ মাটির গুণাগুণ অবক্ষয় হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করবে। যখন ভূমি অবক্ষয় হয়, তখন এটি খাদ্য সুরক্ষা, জলের প্রাপ্যতা ও বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। সরাসরি অর্ধেক মানুষকে প্রভাবিত করে। ভূমি অবক্ষয়কে স্থলজ জীববৈচিত্র্য হ্রাসের একক বৃহত্তম কারণ হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনে যথেষ্ট অবদান রাখে। নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় এবং উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি কৃষিজমি আরও দুর্বল করে তুলছে।
মাটি শুধু খাদ্যের উৎস নয়, এটি শহরের টেকসই অবকাঠামো এবং নাগরিক কল্যাণের মূল ভিত্তি। সুস্থ মাটি বৃষ্টির পানি শোষণ করে, জলাবদ্ধতা কমায়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং বায়ুদূষণ কমায়। এছাড়া এটি সবুজ উদ্ভিদ, গাছ এবং পার্কের জন্য আবশ্যক ভিত্তি সরবরাহ করে, যা কার্বন শোষণ, মানসিক প্রশান্তি এবং উদ্ভিদজীব বৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ।
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করা এবং জৈব সার তৈরি করা উচিত। বাংলাদেশের শহরগুলোতে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই বা মাছি ব্যবহার করে পচনশীল বর্জ্য থেকে জৈব সার, প্রোটিনসমৃদ্ধ হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার উৎপাদন করা যেতে পারে। এটি জলাবদ্ধতা কমাতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এবং মাটির উর্বরতা বাড়াতে সহায়ক।
বৃক্ষরোপণ মাটির সংরক্ষণের জন্য অন্যতম হাতিয়ার। বৃক্ষের শিকড় মাটির ক্ষয় রোধ করে, লতা-পাতা মাটির সঙ্গে মিশে উর্বরতা বাড়ায়। শহরে ছাদবাগান, বারান্দা কৃষি এবং কমিউনিটি গার্ডেন প্রচলন শহরের সবুজায়ন বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের শহরগুলোর পাশাপাশি টোকিও, সিঙ্গাপুর এবং বার্লিনের মতো শহরেও সবুজ ছাদ, উল্লম্ব উদ্যান ও নগর বন তৈরি করে শহরের জীবনমান উন্নয়ন করা হচ্ছে।
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য রাসায়নিক সার, জৈব সার এবং মাইক্রোবিয়াল সারকে বৈজ্ঞানিক ভারসাম্যের ভিত্তিতে ব্যবহার করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ধানের ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে দুই টন গোবর এবং এক টন ছাই প্রয়োগ করলে মাটির কাঠামো শক্ত হয়, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং উদ্ভিদের পুষ্টি গ্রহণ সহজ হয় বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদগণ। ফসল আবর্তন, সবুজ সার, মালচিং এবং সংরক্ষণমূলক চাষাবাদ মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের মাটির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। রিমোট সেন্সিং, জিআইএস, মৃত্তিকা সেন্সর এবং ড্রোনভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রতিটি অঞ্চলের মাটির মান নিয়মিত নিরীক্ষণ করা যায়। ভারী ধাতুদূষণ কমাতে উদ্ভিদ-ভিত্তিক বায়োরেমেডিয়েশন, বায়োচার ব্যবহার এবং ন্যানোটেকনোলজি নির্ভর পদ্ধতি ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মাটি সুস্থ থাকলে শহর সুস্থ থাকে। একটি সুস্থ শহরের বৈশিষ্ট্য হলো পর্যাপ্ত খোলা মাটি, সবুজ এলাকা, পানি ধারণ ক্ষমতা, দূষণ শোষণের ক্ষমতা এবং জীববৈচিত্র্যের অনুকূল পরিবেশ। সুস্থ মাটি তাপমাত্রা কমায়, বৃষ্টির পানি শোষণ করে, বায়ুদূষণ কমায় এবং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রশান্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। অপরদিকে মৃত মাটি নগরকে ধূলিধূসর, গরম, জলাবদ্ধ এবং রোগব্যাধির ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পরিণত করে। শহরের মাটিকে সুস্থ রাখার জন্য নাগরিক, সরকার, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠানদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। সঠিক সময়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত না হলে আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ নগর, নিরাপদ খাদ্য বা টেকসই কৃষি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। মাটি বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এটি কোনো স্লোগান নয়, বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। এখনই মাটির স্বাস্থ্যকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মাটি কেবল ধুলো বা ময়লা নয়। এটি মানবজীবন, খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং নগর জীবনের নীরব রক্ষক। সুস্থ শহরের জন্য সুস্থ মাটি অপরিহার্য। ২০২৫ সালের এই প্রতিপাদ্য আমাদের আহ্বান জানায়, শহরের জীবন্ত স্তরকে রক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য, সবুজ ও টেকসই নগরী উপহার দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এমএস