অ্যানথ্রাক্স: ঝুঁকি এড়াতে সচেতনতা ও প্রতিরোধই ভরসা
২০১০ সালের কথা। বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স ভয়াবহ আকারে দেখা দেয়। গরুর মাংস কেনা, খাওয়া এবং এ পেশার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। চামড়া শিল্পও পড়েছিল হুমকির মুখে। মানুষের শরীরে প্রোটিন দরকার যা মাংসের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু মানুষ ভয়ে মাংস খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। এমন কি গরুর দুধ পানকরা থেকে বিরত থাকতো। জনগণের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও অপপ্রচারের কারণে এবং অতিপ্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। অ্যানথ্রাক্স কোনো জটিল রোগই নয়, ভুল বোঝাবুঝির কারণে সৃষ্টি হয়েছিল আতঙ্কের। আরো একটি বিভ্রান্তি ছিল কোরবানির ঈদ নিয়ে, কারণ দুই এক মাস পরেই কোরবানির ঈদ। মানুষ কোরবানি দিবে কিনা তা নিয়ে ছিল সংশয়ে।
অ্যানথ্রাক্স কি? গবাদি পশুর একটি প্রাণঘাতী রোগ অ্যানথ্রাক্স। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে এটা হয়ে থাকে। গবাদি পশু যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, শূকরের মতো পশুতে রোগটি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এমনকি কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ ছাড়াই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর মধ্যে কি কি লক্ষ্মণ দেখা যায়? আক্রান্ত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।। জ্বর হয়, লোম খাড়া হয়ে যায়, খিঁচুনি ও বমি হয় এবং আক্রান্ত পশু সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। অর্থাৎ গবাদি পশুর জন্য এটি একটি ভয়াবহ রোগ। আক্রান্ত পশুর নাক, মুখ, কান বা পায়ুপথ দিয়ে কালো রঙ্গের তরল বা রক্ত বের হয়, যা জমাট বাঁধে না। অনেক সময় পশুর ঘাড় বা শরীরের কিছু অংশ ফুলে যেতে পারে এবং মৃত্যুর পর শরীর দ্রুত পচে যায়। এ রোগের তেমন কোন কার্যকরী চিকিৎসা নেই।
অ্যানথ্রাক্স কীভাবে পশুর মধ্যে ছড়ায়? অ্যানথ্রাক্সকে বলা হয় সয়েল বেজড্ রোগ। এটি মাটির মাধ্যমে পশুর মধ্যে ছড়ায়। অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু স্পোর হিসেবে অনেকদিন, এমনকি শত বছর বাঁচতে পারে। পশু আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার পর সেই মৃত পশুর ভুঁড়ি বা মাংস যেখানে ফেলে রাখা হয়, কিংবা যেখানে চামড়া কাটা হয়, সেখানকার ঘাসে জীবাণু ছড়িয়ে পরে। অন্য কোনো পশু যদি সেই জীবাণুযুক্ত ঘাস খায়, তাহলে সে পশুটিও আক্রান্ত হয়।
মানুষের অ্যানথ্রাক্স কত ধরনের? মানুষের অ্যানথ্রাক্স সাধারণত তিন ধরনের হয়— চর্ম, পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রে। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে যারা আসে, কিংবা যারা চামড়া বা মাংস কাটে তাদের চর্ম জাতীয় অ্যানথ্রাক্স হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ত্বক বা চামড়ায় প্রথমে ছোট ফুসকা বা ঘা দেখা দেয়, তাকে বলে মেলিগনেন্ট পাস্টিউল বা পুঁজভর্তি ফোড়া।
আক্রান্ত পশুর মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ করে না খেলে পরিপাকতন্ত্রে অ্যানথ্রাক্স হয়ে থাকে। এতে পেট ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া এবং পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে।
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মিডিয়া, পত্র পত্রিকা, টেলিভিশন এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে, অ্যানথ্রাক্সে ভয় নয়, সচেতনতা ও নিয়মিত পশুকে টিকাদানের মাধ্যমেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আরেকটি হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। বাতাসে, উল, পশম বা লেদারে লেগে থাকা জীবাণু বা ষ্পোর ফুসফুসে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে পানি ঝরা, বুক ব্যথা হতে পারে। একে বলা হয় উল সর্টার ডিজিজ, যা অত্যন্ত মারাত্মক। সময়মতো চিকিৎসা না দিলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
আমাদের দেশে শুধু চর্মের রোগটাই দেখা যায়। ফুসফুসে আক্রান্ত বা পেটে আক্রান্ত রোগী এখনো আমাদের দেশে পাওয়া যায়নি।
অ্যানথ্রাক্স কীভাবে মানুষের মধ্যে ছড়ায়? মানুষ আক্রান্ত হয় সাধারণত মৃত বা আক্রান্ত পশুর লালা, রক্ত, হাড্ডি, চামড়া বা পশম ও মাংসের সংস্পর্শে এলে। এমনকি আক্রান্ত পশুর মাংস স্পর্শ বা নাড়াচড়ার মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত পশুর চামড়া থেকে ট্যানারিতে কর্মরত শ্রমিকদের মাঝে ছড়াতে পারে। তাই কসাই, খামারি ও ট্যানারি কর্মীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। আক্রান্ত পশুর মাংস ফ্রিজে রাখলেও অ্যানথ্রাক্স এর জীবাণু থাকে। আক্রান্ত প্রাণীর গোস্ত আধাকাচা বা আধারান্না করে খেলে গ্যাস্ট্রোইনটেসটাইনাল অ্যানথ্রাক্স হবার ঝুঁকি থাকে, তবে ভালো করে সিদ্ধ মাংস খেলে আশঙ্কা থাকে না। রান্নার আগে যারা কাঁচা মাংসের সংস্পর্শে যান তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে জীবানুর স্পোর ফুসফুসে ঢুকলে তা আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগে মানুষ আক্রান্ত হলে মারা যাওয়া কিংবা বিকলাঙ্গ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
অ্যানথ্রাক্স কি ছোঁয়াচে? এটা ছোঁয়াচে নয়, মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় না। তাই এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই এবং কেউ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে তার থেকে দূরে থাকারও কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটা সংক্রমিত হওয়ার কোনো আশঙ্কাই নেই। আসলে অ্যানথ্রাক্স শুধুই পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয় এবং যারা আক্রান্ত পশু হ্যান্ডেল করে তারাই মূলত আক্রান্ত হয়। যারা পশুপালন ও ট্যানারি শিল্পের সাথে জড়িত তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
অ্যানথ্রাক্স কি বাংলাদেশে আগে ছিল? অ্যানথ্রাক্স বর্তমানে আমাদের দেশে একটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। কিন্তু এটা কোনো নতুন রোগ নয়, বরং একটি পুরানো রোগ। আগেও আমাদের গ্রামগঞ্জে এ রোগের ছড়াছড়ি ছিল। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন জেলায় এর প্রাদুর্ভাব একটু বেশি দেখা যায়। অতীতে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯১ সালে মিশরেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। এমনকি গ্রিস, রোম এবং ভারতবর্ষেও এ রোগ ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পরে বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় এ রোগ ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পরে এবং ২০০৮ সালেও যুক্তরাজ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব পাওয়া যায়।
স্বাভাবিক গরুর মাংস ও আক্রান্ত গরুর মাংস চেনার কোনো উপায় আছে কি? এটা আসলে চেনার কোনো উপায় নেই। আর আক্রান্ত গরু জবাই করা তো নিষেধ। কেউ যদি অন্যায়ভাবে আক্রান্ত গরু জবাই করে তাহলে তার দায়ভার বহন করতে হবে অনেককে। আর যদি আক্রান্ত গরুর মাংস বেশি সিদ্ধ করে কেউ খেয়েই ফেলে, তাহলে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নাই।
মানুষের ক্ষেত্রে অ্যানথ্রাক্স কি নিরাময় যোগ্য ? মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে তা শতভাগ নিরাময়যোগ্য। কারণ রোগটি সাধারণত চামড়ায় হয়। সময়মতো ওষুধ সেবনে সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়ে যায়। মারা যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
গরু ব্যবসায়ীদের জন্য পরামর্শ: গরু আসলে আক্রান্ত হওয়ার দু-চার ঘণ্টা থেকে দুই দিনের মধ্যে মারা যাবে। যেহেতু এর কোনো ওষুধ নেই, তাই গরু আক্রান্ত হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীরা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারবে এবং গরুকে টিকা দিতে হবে। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কোনো পশুর অ্যানথ্রাক্স হওয়ার আশঙ্কা নেই। আর যেগুলো আক্রান্ত হয়ে গেছে সেগুলোকে আর কিছুই করার নেই। তবে মারা যাওয়ার পর ৫/৭ ফুট গর্ত করে পুঁতে রাখতে হবে।
প্রতিরোধে করণীয়: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমনের খবর পাওয়া যাচ্ছে, এতে উদ্বিগ্ন না হয়ে, প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
(১) প্রথমত গবাদি পশুকে নিয়মিত অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিন বা টিকা দিতে হবে।
(২) আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু ও মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গবাদিপশু এবং এ রোগে মৃত পশুর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। আক্রান্ত পশুর বসবাসের ঘর ব্লিচিং পাউডার বা সোডা দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।
(৩) আক্রান্ত পশুর পরিচর্যার সময় মাস্ক, গ্লাভস, এমনকি গাউন বা পিপিই পড়া উচিত। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে কেউ এলে তাকে সাবান বা এন্টিসেপটিক দিয়ে হাত মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
(৪) অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশু জবাই বন্ধ করতে হবে, মাংস বিক্রি এবং খাওয়া যাবে না।
(৫) আক্রান্ত এলাকার গবাদি পশু অ্যানথ্রাক্সমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোথাও পাঠানো যাবে না। এমনকি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে মাংস পরিবহনও নিষিদ্ধ করতে হবে।
(৬) বিদেশি গরু আমদানির ক্ষেত্রে ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে।
(৭) অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মৃত পশুর দেহ নদী নালা, খাল বিল, জলাশয় বা খোলা জায়গায় ফেলা যাবে না, পুড়িয়ে ফেললে সবচেয়ে ভালো। সেটি সম্ভব না হলে মাটিতে গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। শেয়াল কুকুর যেন গর্ত করে তা বের করতে না পারে। এমনকি আক্রান্ত পশুর লালা, গোবর, রক্তসহ সবকিছুই একই সঙ্গে পুঁতে ফেলতে হবে।
(৮) গবাদি পশু বহনকারীকে অবশ্যই বিশেষ ধরনের পোষাক পরতে হবে যেন তিনি আক্রান্ত না হন। মৃত পশুটিকেও পলিথিন জাতীয় কাপড়ে প্যাঁচিয়ে নিতে হবে যাতে দেহ থেকে রক্ত, মল মূত্র, লালা ইত্যাদি ছড়িয়ে না যায়। মৃত পশুর চামড়া কোন ক্রমেই ছাড়ানো যাবে না এবং কোন ট্যানারি শিল্পে ব্যবহার করা যাবে না।
(৯) কোনো আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে আসার পর কারো গায়ে যদি সন্দেহভাজন চর্মরোগ দেখা দেয় অথবা শ্বাসকষ্ট, কাশি অথবা পেটের পীড়া দেখা দেয়, তবে অবশ্যই তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
(১০) পশুশ্রমিক, কসাই ও চামড়া ব্যবসায়ীর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। যারা নিয়মিত পশুর সংস্পর্শে থাকেন তারা যেন খামারে কাজ করার সময় গ্লাভস, মাস্ক ব্যবহার এবং কাজ শেষে হাত-পা সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নেন।
(১১) আক্রান্ত ও অসুস্থ পশুর চিকিৎসার জন্য প্রাণীসম্পদ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
(১২) জবাই এর আগে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত।
(১৩) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অসুস্থ গরু বিক্রি ও জবাই এবং মাংস কাটার ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। নিয়মিত মাংসের দোকান পরিদর্শন করতে হবে, এর গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য।
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মিডিয়া, পত্র পত্রিকা, টেলিভিশন এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে, অ্যানথ্রাক্সে ভয় নয়, সচেতনতা ও নিয়মিত পশুকে টিকাদানের মাধ্যমেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
এইচআর/জেআইএম