বাউল থেকে বইমেলা
বন্ধ্যাত্বের এই পথে আমরা কোথায়?
বাংলাদেশ আজ শিল্প-সংস্কৃতির এক গভীর বন্ধ্যাত্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মননশীলতার স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ। এই অচলাবস্থা কেবল দেশীয় শিল্পের বিকাশকেই নয়, আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকেও সংস্কৃতি থেকে বিমুখ করে তুলছে। এর মূল কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো লোকজ সংস্কৃতির প্রাণ বাউলদের উপর ধারাবাহিক নির্যাতন ও তাদের নিরাপত্তাহীনতা। বাউল দর্শন হলো এদেশের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের ভিত্তি। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা বাউলদের আখড়া ভাঙচুর ও তাদের গানের আসরে হামলা একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ এবং চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে বাউল শিল্পীদের আখড়ায় বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে, যেখানে তাদের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র ও আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মানবাধিকার কর্মীদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে বাউলদের ওপর হামলাকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, যা তাদের জীবনধারণ ও শিল্পচর্চাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এই ধারাবাহিক নিরাপত্তাহীনতা তরুণ প্রজন্মকে দেখায় যে, ঐতিহ্যবাহী শিল্পের চর্চা এখানে সুরক্ষিত নয়, ফলে তারা শিল্পের পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং দেশী শিল্পীদের অবমূল্যায়ন এই সংকটকে আরও মারাত্মক করে তুলছে। দেশীয় শিল্পীদের কাজের প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য দেখা যায়। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বেশ কিছু শিক্ষক ও শিল্পী যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করেন যে, দেশে শিল্প প্রদর্শনী ও গ্যালারির সংখ্যা কমে গেছে, এবং শিল্পের জন্য সরকারি বাজেটও অপ্রতুল। এর ফলে তরুণ শিল্পীরা তাদের কাজ প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন না। ছোটপর্দার শিল্পীরাও নিয়মিতভাবে 'ভিউ বাণিজ্য' এবং বিদেশি সিরিয়াল প্রচারের হিড়িকের শিকার হচ্ছেন। ২০২৫ সালের প্রথম দিকে টেলিভিশন প্রযোজক সমিতি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিদেশি ডাব করা সিরিয়ালের প্রচার বেড়েছে প্রায় ১৫%, যার কারণে দেশীয় নাটকের বাজেট এবং নির্মাণ সংখ্যা উভয়ই কমেছে। এর ফলে, মেধা থাকা সত্ত্বেও দেশীয় শিল্পীরা অনিশ্চয়তার শিকার হচ্ছেন এবং নতুন প্রতিভা উঠে আসার পথ কঠিন হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে, দেশের ভেতরে কনসার্ট এবং ইভেন্টগুলোর বিলুপ্তি বা স্থগিতকরণ সাংস্কৃতিক পরিসরকে সংকুচিত করছে। ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বড় কনসার্টগুলো বাতিল বা স্থগিত করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এর একটি প্রত্যক্ষ উদাহরণ হলো, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫ তারিখে রাজধানীর ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিতব্য ‘লেজেন্ডস লাইভ ইন ঢাকা: আলী আজমত ও নগরবাউল জেমস' কনসার্টটি শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান অ্যাসেন কমিউনিকেশন বিবৃতি দিয়ে জানায়, ‘দেশের চলমান অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির কারণে' কনসার্টটি বাতিল করা হয়েছে। একই মাসে, ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় সংগীতশিল্পী অনুভ জৈনর কনসার্টও নিরাপত্তা জনিত কারণে স্থগিত করা হয়। এই কনসার্ট বাতিলের পুনরাবৃত্তি তরুণদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি করছে, কারণ তারা দেখছে যে তাদের পছন্দের শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েও তারা প্রতারিত হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক বিনোদনের সুযোগ বারবার হাতছাড়া হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের এই সময়ে কনসার্ট এবং উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এগুলো কেবল গান শোনার মাধ্যম নয়, বরং দেশের সকল স্তরের মানুষের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় বিনোদনমূলক মুক্তিপথ হিসেবে কাজ করে। বিশেষত একটি জনবহুল দেশে, যেখানে নাগরিক জীবনের চাপ এবং একঘেয়েমি দ্রুত বাড়ে, সেখানে একটি কনসার্ট মানুষের দৈনন্দিন জীবনের স্ট্রেস থেকে মুক্তি দেয় এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ তৈরি করে। একজন শ্রমিক থেকে শুরু করে করপোরেট কর্মকর্তা—সবার জন্যই কনসার্ট এক ধরনের 'মানসিক ডিটক্স'। এই ইভেন্টগুলোতে মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ ভাগ করে নেয়, যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করতে সাহায্য করে। আর যুব সমাজের কাছে, কনসার্ট হলো আত্ম-প্রকাশ এবং সম্মিলিত উৎসাহের প্রতীকী মঞ্চ। কনসার্ট বাতিলের ঘটনাগুলিতে তরুণদের হতাশার কারণ হলো, তারা দেখে যে তাদের উৎসাহ এবং আবেগ প্রকাশের মাধ্যমগুলি সংকীর্ণ হয়ে আসছে। ২০২৪-২০২৫ সালে ঢাকার বিভিন্ন কনসার্টে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে তারা কীভাবে সঙ্গীতকে তাদের শক্তি এবং প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে দেখে। জেমস বা অন্য রক ব্যান্ডের কনসার্টগুলিতে তরুণদের হাজার হাজার কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো কেবল বিনোদন নয়, বরং একটি সামাজিক বন্ধন তৈরি করে। তারা নিজস্ব ফ্যাশন, রুচি ও পছন্দ প্রকাশ করার একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পায়। যখন একটি কনসার্ট বাতিল হয়, তখন কেবল একটি অনুষ্ঠানই বাতিল হয় না, বরং হাজার হাজার তরুণের সেই দিনের জন্য সঞ্চিত আশা এবং স্ফূর্তি প্রকাশের সুযোগটি রুদ্ধ হয়ে যায়। কনসার্টগুলি তাই সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য এবং তারুণ্যের ইতিবাচক শক্তিকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য অপরিহার্য।
সাম্প্রতিক সময়ে শুধু নির্দিষ্ট এক দেশ থেকে সেলিব্রিটি ও সিঙ্গার এনে ইভেন্ট করার হিড়িক তৈরি হয়েছে, যা দেশের শিল্প ও অর্থনীতি উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে একটি বহুজাতিক মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিপুল অর্থ খরচ করে ভারতীয় জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীকে এনে একটি বিশাল কনসার্টের আয়োজন করে, যেখানে দেশীয় প্রায় কোনো শিল্পীকে মঞ্চে সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই প্রবণতা ২০২৫ সালেও অব্যাহত ছিল, যেখানে বছরের শেষ ছয় মাসে কমপক্ষে পাঁচটি বড় ইভেন্টে বিদেশি তারকাদের প্রাধান্য দেখা যায়। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো, যে দেশে কিংবদন্তি শিল্পী জেমস-এর কনসার্ট বাতিল করতে হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে (নভেম্বর, ২০২৫), সেই দেশ কীভাবে বিদেশী শিল্পীদের জন্য শত শত দর্শকের সমাগম নিয়ে ইভেন্ট করার অনুমতি পায়—এই প্রশ্নটি তরুণদের মনে সংস্কৃতির প্রতি বীতশ্রদ্ধা সৃষ্টি করছে। যদি দেশের রক মিউজিকের 'গুরু'ই তার শিল্প নির্বিঘ্নে চর্চা করতে না পারেন, তবে তরুণরা কীভাবে শিল্পের প্রতি আস্থাশীল হবে? এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে যে, বর্তমানে বাংলাদেশে সুস্থ ও মানবিক সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রটি সংকীর্ণ এবং বৈষম্যমূলক।
যখন একটি কনসার্ট বাতিল হয়, তখন কেবল একটি অনুষ্ঠানই বাতিল হয় না, বরং হাজার হাজার তরুণের সেই দিনের জন্য সঞ্চিত আশা এবং স্ফূর্তি প্রকাশের সুযোগটি রুদ্ধ হয়ে যায়। কনসার্টগুলি তাই সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য এবং তারুণ্যের ইতিবাচক শক্তিকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য অপরিহার্য।
সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ের অন্যতম লক্ষণ হলো সিনেমা হল এবং থিয়েটারের দ্রুত বিলুপ্তি। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, এক দশক আগেও যেখানে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০০, সেখানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৫০টিরও নিচে। এই প্রেক্ষাপটে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় যে, দেশের বিভিন্ন শহরে নিয়মিতভাবে ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলগুলো ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। একই চিত্র দেখা যায় মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রেও। নাট্যকর্মীরা অভিযোগ করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং নিয়মিত নাটকের শো করার জন্য ভেন্যু সংকটের কারণে মঞ্চ নাটক প্রায় বিলুপ্তির পথে। নাটকপাড়ায়, বিশেষত ঢাকার বাইরে, মঞ্চের এই করুণ অবস্থা তরুণ নাট্যকর্মীদের পেশা পরিবর্তনে বাধ্য করছে। এছাড়াও, শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মনোযোগের অভাব এই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বকে দীর্ঘায়িত করছে।
২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষে দেশের প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চারুকলা, সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগে ভর্তির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে বরং কিছু ক্ষেত্রে সামান্য হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, প্রকৌশল বা চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ দেখা যায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, পরিবার এবং সমাজ শিল্পকলাকে একটি 'পেশা' হিসেবে উৎসাহিত করছে না। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী তরুণদের মাত্র ২.৫% সরাসরি শিল্পকলার বিষয়গুলো বেছে নিচ্ছে, যা প্রমাণ করে যে, শিল্পচর্চা একটি গৌণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যখন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোই শিল্পকে গুরুত্ব দেয় না, তখন তরুণদের সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে পড়াটা স্বাভাবিক।
এই সংকুচিত সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় এবং সাম্প্রতিকতম ধাক্কাটি আসে যখন ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জানা যায়, ২০২৬ সালে ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক বইমেলাটি অনুষ্ঠিত হবে না। এই খবরটি সাহিত্যপ্রেমী, প্রকাশক এবং সাধারণ পাঠকের জন্য এক বিশাল হুমকির বার্তা নিয়ে আসে। বইমেলা কেবল বই কেনা-বেচার স্থান নয়, এটি লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনক্ষেত্র, যা আমাদের বৌদ্ধিক ও মননশীলতার পরিচায়ক। বাংলা একাডেমি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে, 'ভৌত অবকাঠামোগত সমস্যা এবং নিরাপত্তাজনিত উচ্চ ঝুঁকি' থাকার কারণে এই আন্তর্জাতিক ইভেন্টটি বাতিল করা হয়েছে। একটি জাতির জন্য, যেখানে বইমেলা তার সংস্কৃতি ও প্রগতির প্রতীক, সেখানে এই মেলা বাতিল হওয়ার অর্থ হলো মননশীলতার দরজায় তালা দেওয়া। এটি শুধু একটি ইভেন্ট বাতিল নয়, বরং এটি ইঙ্গিত করে যে, দেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশের ভিত্তি কতটা নড়বড়ে হয়ে গেছে।
এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশ বর্তমানে দুর্বল পৃষ্ঠপোষকতা, উগ্রবাদী হামলা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার, যা তরুণ প্রজন্মকে ঐতিহ্য ও শিল্প থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই সামগ্রিক পরিস্থিতি তরুণ সমাজকে সংস্কৃতি বিমুখ করে তুলছে, যা একটি জাতির দীর্ঘমেয়াদী সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই বন্ধ্যাত্ব কাটাতে প্রয়োজন সমন্বিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
লেখক : সিইও, ইটিসি ইভেন্টস লিমিটেড।
এইচআর/জেআইএম