একাকিত্বের মহানগর

বাংলাদেশে সামাজিক বন্ধন ও ঐতিহ্যের ক্ষয়

ড. মতিউর রহমান
ড. মতিউর রহমান ড. মতিউর রহমান , গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
প্রকাশিত: ১০:২১ এএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫

সমাজতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ টেনিসের 'Gemeinschaft (গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়)' এবং 'Gesellschaft (সমাজ বা ব্যক্তিনির্ভর সম্পর্ক)'-এর দ্বৈত তাত্ত্বিক ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে বাংলাদেশের সমাজের এক গভীর ও দ্রুত পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা যায়। টেনিসের ১৮৮৭ সালের এই বিশ্লেষণ, যা ঘনিষ্ঠ গ্রামীণ সম্পর্ক (Gemeinschaft) এবং চুক্তিনির্ভর নগর সম্পর্ক (Gesellschaft)-এর মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করে, তা বাংলাদেশের চলমান সামাজিক রূপান্তর বোঝার জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ঐতিহাসিকভাবে গ্রামীণ বন্ধনের দেশ বাংলাদেশ আজ দ্রুত অর্থনৈতিক, জনসংখ্যাগত এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত চাপের প্রভাবে নগর একাকিত্ব এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সামাজিক রূপান্তরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই রূপান্তর কেবল জীবনযাত্রার পরিবর্তন নয়, এটি সামাজিক বন্ধন এবং অস্তিত্বের মূল অর্থকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন এখনো Gemeinschaft-এর চমৎকার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত। এই কাঠামো ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারস্পরিক আবেগ এবং পারিবারিক বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যেখানে সমষ্টিগত কল্যাণ ব্যক্তিগত ইচ্ছার চেয়ে অধিক গুরুত্ব পায়। গ্রামীণ জীবনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো এর সামাজিক নেটওয়ার্কের নিবিড়তা ও আস্থায় প্রতিফলিত হয়। গ্রামীণ সমাজে সম্পর্কগুলো মূলত জন্ম, আত্মীয়তা এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবেশীর বন্ধনের মাধ্যমে তৈরি হয়। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অপ্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা জাল (Informal Safety Net) তৈরি করে।

কৃষিকাজ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলো এখানে যৌথ শ্রম এবং সমষ্টিগত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়, যা বিশ্বাস ও পারস্পরিক নির্ভরতার একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। প্রায় ৬০ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার এখনো অর্থ ঋণ, শ্রম বিনিময় এবং জরুরি সহায়তার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই সম্প্রদায়ভিত্তিক নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল। এই উচ্চ নির্ভরতা প্রমাণ করে যে Gemeinschaft-এর মূল ভিত্তি—পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা—এখনো গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে প্রভাবশালী।

গ্রামীণ সমাজের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিবাদ সমাধান পদ্ধতিও Gemeinschaft-এর ধারণারই প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সীমিত প্রভাবের বাইরেও, গ্রাম্য বয়স্করা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় সম্প্রদায় নেতারা এক ধরনের ঐকমত্যভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখেন। এই ব্যবস্থা দ্বন্দ্ব মীমাংসা করে এবং সামাজিক নিয়ম রক্ষা করে, যা রাষ্ট্রীয় আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই পরিচালিত হয়। এই পরিবেশে সামাজিক পরিচয়, ব্যক্তিগত মর্যাদা এবং সমষ্টিগত কল্যাণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ব্যক্তির আচরণ এবং সিদ্ধান্তগুলি প্রায়শই সমষ্টিগত নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা সমাজকে সংহত রাখে।

নগর জীবনের উচ্চ চাপ, অনির্ভরযোগ্যতা এবং বিচ্ছিন্নতা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্ম দেয়। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং প্রতিবেশীর ওপর আস্থার হ্রাস শহরের একাকিত্বের সামাজিক খরচের পরিচয় দেয়। মানুষ ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ হয়ে পড়ায়, সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানের প্রবণতাও কমে যায়।

বাংলাদেশের দ্রুত নগরায়ণ ঐতিহ্যগত গ্রামীণ সামাজিক বন্ধনকে গভীরভাবে বদলে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত চাপ, বিশেষ করে জলবায়ু-সম্পর্কিত অভিবাসনের (Climate-induced migration) কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীর মতো শহরগুলিতে ব্যাপক হারে জনস্রোত আসছে। এই নগরায়ণ Gesellschaft-এর জন্ম দিচ্ছে, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সামাজিক রীতিনীতিকে উৎসাহিত করে।

নগর জীবনে সম্পর্কগুলি প্রায়শই আর্থিক বা পেশাগত প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। টেনিসের মডেল অনুসারে, এটি একটি অনানুষ্ঠানিক ও ব্যক্তিমুখী সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ একে অপরের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। ঢাকার মতো মেট্রোপলিটন শহরে, অভিবাসীরা অনিয়মিত বাসস্থান, অনিশ্চিত চাকরি এবং জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় নিয়ে সংগ্রাম করে। সম্পর্কগুলি সেখানে অত্যন্ত কার্যকরী (Functional) এবং লেনদেনমূলক (Transactional)।

উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, অভিবাসী শ্রমিকরা সাধারণত প্রতিবেশীর সঙ্গে কেবল পেশাগত বা আর্থিক সম্পর্ক বজায় রাখে। গ্রামীণ বন্ধনের মতো ব্যক্তিগত বা আবেগগত ঘনিষ্ঠতা এখানে গড়ে ওঠে না। ফলস্বরূপ, সামাজিক সহায়তা সীমিত হয়ে আসে, এবং এনজিও বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যবাহী কমিউনিটি-ভিত্তিক মডেলের স্থান গ্রহণ করতে শুরু করে। এটি চুক্তিনির্ভর সম্পর্কের বিস্তারকে প্রমাণ করে।

Gemeinschaft-এর নিরাপত্তা জাল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অভিবাসীরা প্রায়শই অনানুষ্ঠানিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে তারা শ্রমিক শোষণ, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং অপর্যাপ্ত বাসস্থানের ঝুঁকিতে পড়েন। শহুরে জীবন স্বাধীনতা এবং সুযোগ দিলেও, তা সামাজিক সংহতি ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করে। নগর জীবনের উচ্চ চাপ, অনির্ভরযোগ্যতা এবং বিচ্ছিন্নতা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্ম দেয়। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং প্রতিবেশীর ওপর আস্থার হ্রাস শহরের একাকীত্বের সামাজিক খরচের পরিচয় দেয়। মানুষ ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ হয়ে পড়ায়, সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানের প্রবণতাও কমে যায়।

Gesellschaft-এর এই রূপান্তরে সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই বিদ্যমান। নগর জীবন ব্যক্তি স্বাধীনতা, উদ্ভাবন এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে অগ্রগতি করার সুযোগ দেয়। তথ্যপ্রযুক্তি, লজিস্টিকস এবং গার্মেন্টস-এর মতো উদীয়মান খাত নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। তবে, Gemeinschaft-এর নেটওয়ার্কের অবনতি সমাজের দুর্বলতা বাড়ায়। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকায় নগর দারিদ্র্য ২৫ শতাংশেরও বেশি, যা আংশিকভাবে অনিয়মিত চাকরির কারণে। নগর জীবনের প্রতিযোগিতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য সামাজিক সংহতিকে আরও দুর্বল করে তোলে।

এই সামাজিক রূপান্তর নারীদের অবস্থানেও জটিল প্রভাব ফেলেছে। গ্রামীণ Gemeinschaft-এ নারীরা যৌথ শ্রম, স্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষুদ্রঋণ গ্রুপে অংশ নিয়ে সামাজিক পুঁজির অধিকারী ছিলেন। নগর অভিবাসন গ্রামীণ নারীদের এই সমর্থন ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। এর ফলে নারীদের উপর অ-পরিশোধিত শ্রমের (Unpaid Labour) চাপ বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক সুরক্ষা কমে যায়। শহরে, বিশেষত নারী-প্রধান অভিবাসী পরিবারগুলি অনিয়মিত চাকরির কারণে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, নগরের অভিবাসী নারীরা গ্রামীণ নারীর তুলনায় ৪০-৫০ শতাংশ বেশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন।

গ্রামে নারীরা মূলত কৃষিভিত্তিক শ্রম বা কুটির শিল্পে জড়িত ছিলেন, যেখানে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব কম ছিল। শহরে এসে তারা গার্মেন্টস বা অনানুষ্ঠানিক সেবামূলক খাতে কাজ করতে শুরু করেন। এই কাজের পরিবেশ প্রায়শই অনিরাপদ এবং বিচ্ছিন্নতাপূর্ণ, যা তাদের সামাজিক বন্ধন তৈরিতে আরও বাধা সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এলেও, সামাজিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা কমে যায়। Gesellschaft-এর এই পরিবেশে নারীর ভূমিকা প্রধানত ব্যক্তিগত বা পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে যায়, যেখানে গ্রামীণ সমাজের মতো সমষ্টিগত সমর্থন প্রায়শই অনুপস্থিত থাকে, যা তাদের দ্বিগুণ বোঝার (Double Burden) শিকার করে।

বাংলাদেশের উন্নয়নকে গ্রামীণ বন্ধনের সুবিধা এবং নগর জীবনের ব্যক্তিমুখী সুবিধার মধ্যে একটি সংবেদনশীল ভারসাম্য রাখতে হবে। কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, সামাজিক সংহতিও (Social Cohesion) টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

শহরে সামাজিক সংহতি বজায় রাখার জন্য Gemeinschaft-এর ধারণার আদলে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। কমিউনিটি সেন্টার, সমবায় আবাসন এবং নগর মাইক্রোফাইন্যান্স গ্রুপ-এর মতো উদ্যোগগুলি নগর জীবনে বিচ্ছিন্নতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। নীতি-নির্ধারকদের উচিত ঐতিহ্যবাহী সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোকে নগর নীতি পরিকল্পনার সঙ্গে সংহত করা।

শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, এবং অবকাঠামো বিনিয়োগ নিশ্চিত করবে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সামাজিক ঝুঁকিকে ব্যাহত না করে। অভিবাসীদের জন্য আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা জাল (Formal Safety Net) যেমন: সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশু যত্নের সুবিধা তৈরি করা অপরিহার্য। এই ব্যবস্থাগুলি Gemeinschaft-এর অনুপস্থিতিতে দুর্বল পরিবারগুলোকে সহায়তা করবে। গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যবাহী সামাজিক মূল্যবোধগুলোকে নগর জীবনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে। এটি নতুন প্রজন্মের মধ্যে সমষ্টিগত দায়িত্ববোধের ধারণা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশে Gemeinschaft থেকে Gesellschaft-এর রূপান্তর শুধু একটি সামাজিক পরিবর্তন নয়, এটি ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যকার একটি গভীর দার্শনিক সংগ্রাম। গ্রামীণ বন্ধন, যা আত্মীয়তা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, ধীরে ধীরে নগর একাকীত্ব, লেনদেনমূলক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দিক পরিবর্তন করছে। নগর জীবন সুযোগ এনে দিলেও এটি সামাজিক সংহতি, সম্প্রদায়ের আস্থা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করছে।

টেনিসের দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ভারসাম্য রক্ষা করছে—সম্প্রদায়ের অন্তরঙ্গতা এবং সমাজের ব্যক্তিমুখী চাহিদার মধ্যে একটি সফল সমন্বয় প্রয়োজন। ঐতিহ্যবাহী সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং সেগুলোকে নগর নীতি পরিকল্পনার সঙ্গে কার্যকরভাবে সংহত করার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক গতিশীলতা এবং সামাজিক সংহতি—উভয়কেই একসাথে বজায় রাখা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে এই সামাজিক বন্ধনগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার এবং নগর জীবনের মানবিক দিকগুলো নিশ্চিত করার ক্ষমতার ওপর।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।