মমত্ববোধ জাগ্রত হোক, ফিরে আসুক জলাভূমি

জলাভূমি শুধুই জলাশয় বা জল বিভাজিকা নয়। এর অনেক অনেক গুরুত্ব রয়েছে। জলাভূমি প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সর্বোপরি মানব জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জলাভূমির অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও অপরিসীম। জলাভূমিকে কোন কোন পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রতিবেশের রক্ত বা ব্লাডের সঙ্গে তুলনা করেছেন; আবার কেউ কেউ একে প্রতিবেশের হৃদয় হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়া জীব-জীববৈচিত্র্য অস্তিত্বের প্রয়োজনে এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের সুস্থভাবে ও সঠিকভাবে বেঁচে থাকার নিমিত্তে জলাভূমি সমূহ বাঁচাইয়া রাখা জরুরি। এ অমূল্য সম্পদকে অবহেলা করা যাবে না এবং আমরা অবহেলা করতে পারি না। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এবং কমিউনিটির সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন ও প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশের অন্যতম একটা বড় সমস্যা হলো আমাদের শহর ও নগরগুলোর ঊর্ধ্বমুখী  সম্প্রসারণ; তার পরিবর্তে আমরা অনুভূমিক  সম্প্রসারণ করতে পারি। যার ফলে নদ-নদী, নীচু জমি, খাল, বিল, জলাশয়, জলাভূমি প্রভৃতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। আমাদের শহরগুলোকে আমরা কংক্রিটের রাস্তা, সবকিছু কার্পেটিং বা প্লাস্টার করে দিতে চাই। ফলশ্রুতিতে বৃষ্টির পানি ভূ-পৃষ্ঠের নিচে পৌঁছাতে পারে না। উপরন্তু, জলাবদ্ধতার কারণে বৃষ্টির পানি জলাশয়গুলিতে পৌঁছায় না। এতদ্ভিন্ন, জলাভূমি ভরাট করার কারণে প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে। সুতরাং আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটার পুনরায় পূর্ণ হচ্ছে না। বাংলাদেশে ভূমিদস্যুরা জলাভূমি ধ্বংস করার নেপথ্যে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। তাছাড়া সূত্র থেকে জানা যায়, ভূমিদস্যুরা সচেতন নয় আবার তারা সংগঠিত। তারা প্রকৃতপক্ষে জানে না; আসলে তারা পরিবেশ ও প্রতিবেশের কত বড় ক্ষতি করে চলেছে। তারা পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধও করে চলেছে। জলাভূমি ভরাটের কারণে জলাবদ্ধতা এবং বন্যা হয়ে থাকে ও জলাভূমি ধ্বংস হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়াটার টেবিল দিন দিন নিঃশেষ হচ্ছে।

জলাভূমির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও খাদ্য নিরাপত্তা

জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় জলাভূমি সংরক্ষণে সকলে সচেষ্ট হতে হবে। উপকূলীয় জলাভূমি যেমন-সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহকে রক্ষা করে এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় বাফার হিসাবে কাজ করে। এতদভিন্ন. সুন্দরবন সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতা, মধু, মোম, বাঘ, হরিণ, বানর, বন মোরগ, পাখি, শুকুর, সাপ, ডলফিন, কুমির, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী, পাখি ও সরীসৃপের আবাসস্থল; যা ঐ এলাকার জীবন, জীবিকা ও দেশীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে।

জলাভূমি একদিকে যেমন : পানিকে দূষকমুক্ত করে এবং অন্যদিকে পানির গুণাগুণের উৎকর্ষ স্বাধন করে। উপরন্তু, জলাভূমি বৃষ্টি ও বন্যার অতিরিক্ত পানি ধরে রাখে, এটি পানি প্রবাহের বেগ, গতি এবং পরিমাণ কমায়ে দেয় ও জান-মালের ক্ষতি কমায়। জলাভূমি ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পুনরায় পূর্ণ করে; যা মানুষের পানীয় জলের বড় উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয় (গোপাল ও চোহান, ২০০৬)। জলাভূমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্যের প্রাণকেন্দ্র বলে অভিহিত। কেননা দেশের মানুষের শতকরা ৬০ ভাগ আমিষ এ উৎস থেকে আসে।

এস, এন, ইসলাম (২০১৬) এক গবেষণা থেকে জানান, জলাভূমিগুলি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ও নার্সারি হিসাবে কাজ করে এবং লক্ষ লক্ষ জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। হাওর, বাওড়, বিল প্রভৃতি জলাভূমি বন্যা বাহিত উর্বর পলি ধারণ করে; যা বোরো ধান আবাদে এবং বেশি ফসল ফলনে প্রভূত সহায়তা করে। এছাড়া বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরগুলি লক্ষ লক্ষ দেশীয় এবং পরিযায়ী পাখির গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। এ হাওরগুলি জলজ প্রাণিরও এক বড় আবাসস্থল (আই ইউ সি এন, ২০১৫)। জলাভূমি মানুষকে অকৃত্রিম বিনোদন দিয়ে থাকে। বর্ষাকালে নৌকা বাইচ, নাটক, যাত্রা, পিঠা উৎসব, ঐতিহ্যবাহী গান-যেমন ভাটিয়ালী, জারি, সারি ইত্যাদি ও অন্যান্য উৎসবগুলি জলাভূমির পরিবেশেই আয়োজিত হয়ে থাকে এবং আবাল বৃদ্ধ-বণিতার অংশগ্রহণে উৎসবগুলি প্রাণ চঞ্চলতা ও সফলতা পেয়ে থাকে।

বাংলাদেশের জলাভূমিগুলি নানা হুমকির সম্মূখীন:-

প্রথমত: বাংলাদেশের জলাভূমিগুলি বিভিন্নমুখী সমস্যায় আক্রান্ত। কৃষিকাজ, ঘরবাড়ি তৈরি, স্থাপনা তৈরি, শিল্প, কল-কারখানা তৈরি, বিনোদন কেন্দ্র, খামার ইত্যাদি তৈরি করতে জলাভূমি জবর দখল করা হয়ে থাকে। তাছাড়া জলাভূমি ভরাট করে; প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়; ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত: অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং অবৈধ মাছ শিকার করার কারণে মাছের প্রজনন ব্যাহত হয় এবং ছোট ছোট মাছ, পোনা-মাছ, বড় মাছ ও অন্যান্য মাছ মারা যায়।

জলাভূমি ধ্বংসের ফলে আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জলাভূমির বিলুপ্তির সাথে সাথে দেশীয় প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণী, পশু, পাখি, কচুরি পানা, শাপলা, পদ্ম এবং অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ নিঃশেষ হচ্ছে। আর মানুষ খাবার পানি, পশু-পাখির খাবার পানি, কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চাষের পানি, শিল্প ও কল-কারখানার জন্য ব্যবহৃত পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তৃতীয়ত: শিল্প, কৃষি ও গৃহস্থালির বর্জ্যের দূষণের মাধ্যমেও জলাভূমির ক্ষতি হয়ে থাকে। চতুর্থত: বাংলাদেশের উজানে বাঁধ এবং ব্যারেজ নির্মাণের ফলে পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা হয়ে থাকে বলে জানা যায়। পঞ্চমত: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় জলাভূমিতে সমুদ্রের লোনা পানির অনুপ্রবেশ ও দূষণ সংশ্লিষ্ট জলাভূমির জন্য হুমকি তৈরি করছে।

এখন জলাভূমির ধ্বংস ও ধ্বংসের প্রভাবের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। জলাভূমি ধ্বংসের ফলে আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জলাভূমির বিলুপ্তির সাথে সাথে দেশীয় প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণী, পশু, পাখি, কচুরি পানা, শাপলা, পদ্ম এবং অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ নিঃশেষ হচ্ছে। আর মানুষ খাবার পানি, পশু-পাখির খাবার পানি, কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চাষের পানি, শিল্প ও কল-কারখানার জন্য ব্যবহৃত পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

একজন বিশেষজ্ঞ একদা বলছিলেন, সারফেস ওয়াটার বা ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানির অভাবে বায়ুমণ্ডলে ময়েশ্চারের অভাব ঘটে এবং মানব শরীরে শুষ্কতা দেখা দেয়, ফলে প্রাণী ও উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপরন্তু, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতি হয়। বেশ কয়েক বছর পূর্বে ইমেরিটাস প্রফেসর নজরুল ইসলামের একটা সাক্ষাৎকার শুনেছিলাম, তো তিনি বলছিলেন থাইল্যান্ড ১০-১২ টি খালকে উদ্ধার করেছে। আমরাও বেগুনবাড়ী খালকে মনোরম নয়নাভিরাম ও অনিন্দ্য সুন্দর হাতিরঝিলে রূপান্তরিত করতে পেরেছি। এখন তা নগরবাসীর বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। 

প্রায় চার দশক পূর্বে আমার এক কলেজ শিক্ষক চাচা একদিন আমাকে বলেছিলেন, এশিয়ার দেশগুলোতে যখন কোনো নতুন শহর বা কোনো প্রতিষ্ঠান করা হয় তখন নিচু জমি বা জলাশয়কে বেছে নেয়া হয়। এর একটা বড় সুবিধা হলো কম পয়সায় ভূমি পাওয়া যায়; সেক্ষেত্রে কেবল জলাশয় ভরাট করলেই স্থাপনা তৈরি করা যায়। আর সেজন্যই শহরগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা যায়। বাংলাদেশে অনেক নিচুভূমি ও জলাভূমি ভরাট করে অনেক প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা করা হয়েছে মর্মে অনেক তথ্য রয়েছে।

একসময় রাজশাহী শহরকে বলা হতো পুকুরের শহর। অথচ এখন কদাচিৎ রাজশাহী শহরে পুকুর দেখা যায়। আমরা আমাদের নিচুভূমি বা জলাশয়গুলি প্রতিনিয়ত ভরাট করে চলেছি। আমরা আমাদের নদ-নদী, হাওর, বাওড়, বিল, ঝিল, পুকুর, খাল, দীঘি গুলোকে খনন করতে পারি এবং অবৈধ দখলমুক্ত করতে পারি। তাছাড়া দূষিত জলাশয়গুলিকে চিহ্নিত করতে পারি এবং দূষণমুক্ত করে সেগুলোকে পূর্ণজন্ম দিতে পারি। তাহলে জলাভূমিগুলি বাঁচবে। সেই সাথে আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

ড. এম. এ. সোবহান পিপিএম কমান্ড্যান্ট (ডিআইজি), পরিবেশ বিজ্ঞানী, পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙ্গামাটি।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।