মানবতার সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ: বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী
সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় আনুমানিক বিকেল ৩টা ৪০ মিনিট থেকে ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ড্রোন হামলা চালায়। হামলায় দায়িত্বরত ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী শহীদ হন এবং আটজন আহত হন।
আইএসপিআর জানায়, শহীদ শান্তিরক্ষীরা হলেন করপোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা (রাজবাড়ী), সৈনিক শান্ত ম-ল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) ও লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)
আহত শান্তিরক্ষীরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, কর্পোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, ল্যান্স কর্পোরাল মহিবুল ইসলাম, সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, সৈনিক মোসা. উম্মে হানি আক্তার, সৈনিক চুমকি আক্তার, অর্ডন্যান্স ও সৈনিক মো. মানাজির আহসান, বীর (নোয়াখালী)।
জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানো ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে মর্যাদাপূর্ণ স্থান অক্ষুণ্ন রেখে আসছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম স্থানে ছিল। তার আগেও কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের বহু গৌরবময় অধ্যায়ের অংশ বাংলাদশের শান্তিরক্ষীরা।
আইএসপিআর আরও জানায়, আহত আটজন শান্তিরক্ষীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে সৈনিক মো. মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এরইমধ্যে তার সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। অন্য আহত সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং তারা সবাই শঙ্কামুক্ত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। শহীদ শান্তিরক্ষীদের আত্মত্যাগ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় নিদর্শন হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয় এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয় বলেও জানিয়েছে আইএসপিআর।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বময় ভূমিকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর এক মহৎ অর্জন হলো, শান্তিরক্ষা মিশনে (পিস কিপিং অপারেশন) অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক কৃতিত্ব ও অর্জনসমূহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্রবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেমন- দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে, তেমনি বিদেশে পেশাদারত্ব ও নিবেদিত প্রাণ মনোভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে সংঘাতকবলিত বিদেশিদের মন জয় করেছে।
আমাদের সৈন্যরা দুর্গত মানবতার সেবায় যেমন কাজ করেছেন, তেমনি বিশ্বে শান্তি বিনষ্টকারী আগ্রাসী বাহিনীর মোকাবিলাও করেছেন। এক সংগ্রামী জাতির বাহিনী হিসেবে সবসময় তারা মানবতার ক্ষেত্রে নিজেদের উৎসর্গ করেন।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের আর্থিক অবদান কম হলেও বাংলাদেশের সৈন্যরা প্রাণ উৎসর্গ করে শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনায় কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীর সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৮৮ সালে ইরাক ও নামিবিয়া শান্তি মিশনে যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তি মিশন শুরু করে।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শুরু হয়েছিল ১৫ জন দিয়ে। সেটা ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধে মিলিটারি পর্যবেক্ষক হিসেবে। এরপর দিন দিন বেড়েছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর চাহিদা। গত ৩৪ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সশস্ত্র বাহিনীর ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৯ জন অংশ নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৪০ দেশে ৫৪টি শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এক লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৯ জন সদস্য অংশ নেন। বর্তমানে বিশ্বের আটটি দেশের ৯টি শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত আছেন ছয় হাজার ৮৩২ জন। নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর ৭০১ জন নারী শান্তিরক্ষী সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। বর্তমানে ৩৭২ জন নারী শান্তিরক্ষী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন দেশে পরিচালিত জাতিসংঘ শান্তি মিশনে গৌরবের সঙ্গে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তিরক্ষা অভিযানে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য জীবন দিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৫৭ জন। এদের মধ্যে ১৩১ জন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর, চারজন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর, ৯ জন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এবং ২৪ জন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য ছিলেন।
জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানো ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে মর্যাদাপূর্ণ স্থান অক্ষুণ্ন রেখে আসছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম স্থানে ছিল। তার আগে কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের বহু গৌরবময় অধ্যায়ের অংশ বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সব সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পদচিহ্ন রয়েছে। লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে আফ্রিকার গহিন বন থেকে শুরু করে উত্তপ্ত মরুভূমিতে। সংঘাতময় সমুদ্র এলাকায়ও উড়ছে বাংলাদেশের শান্তির পতাকা। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহ গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক আদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্য পেছনে ফেলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেন বিশ্বমানবতার সেবায়। নীল হেলমেট মাথায় নিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের প্রায় সবখানে। শান্তিরক্ষীদের পেশাগত দক্ষতা, অঙ্গীকার, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিক কারণে বিশ্বের সব মানুষের কাছে আজ তারা দৃষ্টান্ত স্বরূপ।
লেখক : সাংবাদিক
এইচআর/এএসএম