রাজাকারের তালিকা : খামখেয়ালিপনার দায়-দায়িত্ব

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। অন্যান্য দল, বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই তালিকা তৈরির উদ্যোগ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, ৪৮ বছর পর এই তালিকা তৈরির প্রয়োজন কী? বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের মতো সাধারণ আন্দোলন করে স্বাধীনতা লাভ করেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে যুদ্ধ করে। সুতরাং তার পক্ষে যুদ্ধ করার লোক ছিল আর তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ ছিল। বিরুদ্ধের লোকেরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করেছে আর প্রতিরোধ গড়ে তুলে যুদ্ধটাকে বানচাল করে দেয়ার চেষ্টা করেছে।

বাংলাদেশের মহাফেজখানায় ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে উভয়পক্ষের যোদ্ধাদের তালিকা থাকা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধারাও এ মাটির সন্তান আর রাজাকাররাও এদেশের মানুষ। সুতরাং স্বাধীনতাযুদ্ধে এদেশের মানুষের কার কী ভূমিকা ছিল তার বিস্তারিত বিবরণী না থাকলে তো জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে সত্য; যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের লোকদের নামের একটা বিবরণী থাকা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিবরণী রয়েছে কিন্তু স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ ঠেকানোর জন্য পাকিস্তানি বাহিনী যেসব বাহিনী গড়ে তুলেছিল তাদেরও একটা লিস্ট লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল।

১৯৭৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের মুখ্য দল ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় সেই বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার কেউ ছিল না। ১৯৯৬ সালে সেই দল পুনরায় ক্ষমতায় আসায় এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় পুনরায় জাতির মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ ইতিহাসকে সম্পন্ন করার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেই হিসেবে রাজাকারদের তালিকা তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং আমরা মনে করেছিলাম একটি সুন্দর, স্বচ্ছ তালিকা জাতি পাবে। কিন্তু দেখলাম মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় একটি লিস্ট প্রকাশ করেছে যেই লিস্টে রাজাকারের পাশাপাশি শতশত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামও রয়েছে।

এই অবহেলার জন্য কারা দায়ী? মুক্তিযুদ্ধের সরকার একটি খামখেয়ালিপনার মধ্যে রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নামের একটি মিশ্র তালিকা প্রকাশ করে জাতির সঙ্গে বড় প্রতারণা করেছে। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুঃখ প্রকাশ করে, ক্ষমা চেয়ে এই অপরাধ অপনোদন হওয়ার নয়। সরকার নাকি এই তালিকা তৈরি করার জন্য ৬০ কোটি টাকাও দিয়েছিল। এখন মন্ত্রণালয় বলছে, ৬০ পয়সাও খরচ হয়নি। হয়তো তালিকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না হলে নয়-ছয় করে এই টাকাও হজম করা হয়ে যেত।

যে দেশে ২০০ টাকার বালিশের দাম ৭৫০০ টাকা হয় সেই দেশে ৬০ কোটি টাকা হজম করা তো কোনো ব্যাপারই নয়। শুধু সঙ্ঘবদ্ধ একটা গোষ্ঠী দরকার। ঘাটে ঘাটে অনুরূপ সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্ঠীর তো অভাব নেই। সমগ্র দেশেই তো ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগহীনতার অভাব। ন্যায়পরায়ণতা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে তিরোহিত হতে চলছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থ হলে জাতীয় চরিত্রও দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। জাতি তো এখন বিভ্রান্তিতে ভুগছে। এই জাতির কেউই এখন অপরাধকে অপরাধ মনে করছে না। একদল উন্নয়নের কথা বলে গলা ফাটাচ্ছে, প্রবৃত্তির কথা উঠলেই বেহুশ হয়ে যাচ্ছে।

যে জাতিকে খামখেয়ালিপনায়, দায়িত্বহীনতায়, অসততায় পেয়ে বসেছে- সে জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন তো সম্ভব হবে না। মন্ত্রিসভায় শক্তিশালী মানুষ নেই, প্রশাসনের শক্তিশালী মানুষ নেই, আইনের সার্বভৌমত্ব নেই। সুতরাং জাতিকে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে কে? চাটুকার আর বক্তৃতাজীবীরা সর্বত্র রাজত্ব কায়েম করছে।

গত ২০ এবং ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন অধিবেশন হলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে মঞ্চ থেকে বলা হলো সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করবেন। তিনি মঞ্চে উঠে দীর্ঘ ত্রিশ মিনিট বক্তৃতা দিলেন। তাতে সংগঠনের কোনো একটা কথা ছিল না। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় সভানেত্রীর শুধু স্তুতি গাইলেন। বন্দনাতেই তার বক্তৃতা শেষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এত বন্দনার প্রয়োজন কী ছিল! ৩৮ বছরব্যাপী তিনি দলের সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা, দীর্ঘ ১৬ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা গৃহবধূও তাকে চেনে। তার এত বন্দনার প্রয়োজন কী সাধারণ সম্পাদকের দ্বারা!

ওবায়দুল কাদের পুনরায় সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। কাউন্সিলরদের যে সেন্টিমেন্ট দেখেছি সরাসরি নির্বাচন হলে তিনি সাধারণ সম্পাদক হতে পারতেন কিনা জানি না। যাই হোক তিনি এখন সাধারণ সম্পাদক। না পারছেন তিনি মন্ত্রণালয় সামাল দিতে, না পারছেন দলকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে। সুতরাং স্তুতি ছেড়ে, আশা করি কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি সভানেত্রীকে সাহায্য করবেন। চাটুকার কখনো প্রকৃত বন্ধু হয় না। জ্ঞানী লোকেরা এমন কথাই বলেছেন।

আমরা সাংবাদিকতা করি। অকপটে যা সত্য বলে মনে করি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করি। পক্ষে গেলে ধন্যবাদ দেয়ার কেউ নেই, বিপক্ষে গেলে গলা টিপে ধরার মানুষেরও অভাব নেই। একদলের পক্ষে গেলে বিপক্ষ দলের লোকেরা বলে পক্ষের দলের দালাল। এক বন্ধু বললেন, এত কথা লিখছ তোমার গর্দানে কল্লা কয়টা? আমার গর্দানে কল্লা একটাই। তাই বলে কি আমার উপলব্ধির কথা লিখব না?

যাই হোক লিখছিলাম রাজাকারের তালিকা নিয়ে। যারা রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক- সব মিলিয়ে এই তালিকা তৈরি করেছেন তাদের বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর এই দায় নিতে হবে। পদত্যাগ করা বা কোনো ব্যতিক্রমধর্মী ভুলের জন্য মন্ত্রীর পদত্যাগের রেওয়াজ আমাদের দেশে নেই। তাই সব মন্ত্রী পদত্যাগ করেন না। তারা যে তাদের যোগ্যতার চেয়ে বড় পদ আঁকড়ে আছেন তা তাদের উপলব্ধিতে কখনো থাকে না।

এত বড় দায়িত্ব পালনে যারা একনিষ্ঠ ছিলেন না তাদের মন্ত্রী থেকে আমলা সবারতো তো সাজা হওয়া দরকার। অপরাধের পর তারা আবার প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছেন- যাদের নাম ভুলে উঠে গেছে সংশোধনীর মাধ্যমে তারা যেন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। কত বড় ফাজলামি!

যাক, অবশেষে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তালিকাটি সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। আমরা পরামর্শ দেব বর্তমান তৈরি করা তালিকাটা সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে নতুন একটি তালিকা তৈরি করার জন্য এবং যাদের দায়িত্ববোধ এখনও টিকে আছে অনুরূপ লোককে যেন দায়িত্ব প্রদান করা হয়। অনেকে বেসরকারিভাবে রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করেছেন এবং বাজারে এই সংক্রান্ত বইও প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকেও সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

প্রতিটি কাজে খামখেয়ালিপনা দায়িত্ববোধকে সম্পূর্ণভাবে দুর্বল করে ফেলেছে। একটা জাতি পঙ্গু হওয়ার জন্য এই একটা দোষই যথেষ্ট।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।