মানুষ কখনো হারে না

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৪১ এএম, ১৬ মার্চ ২০২০

সাগর বিশ্বাস

করোনা নিয়ে গোটা দুনিয়ায় যে হৈ চৈ শুরু হয়েছে, তা কোথায় গিয়ে থামবে তা এখনই বলা মুশকিল। বাসে-ট্রেনে, রাস্তায়- ফুটপাথে, বাজারে-অফিসে, ড্রয়িংরুম থেকে বেডরুম, হোটেল থেকে রেস্তোরাঁয় সবখানে গল্প শুধু একটিই– করোনা ভাইরাস।

স্বামী-স্ত্রী কথা বলছেন সংসারের হিসাব নিকাশ নিয়ে, সেখানেও করোনা! বন্ধুদের মাঝে গল্প– তা করোনার চেয়ে ভালো বিষয় আর কি হতে পারে! প্রেমিকা আজও যথারীতি দেরি করে এসেছে। কিন্তু প্রেমিকপ্রবর রাগবে কি! বরঞ্চ যার-পর-নাই হতাশ হোল প্রেমিকার মুখ জুড়ে বেঢপ আকারের মাস্ক দেখে।
প্যারা এখনো শেষ হয়নি । বয়স হয়েছে তাই শরীর ফিট রাখার জন্যে একটু কাঁচা শশা, টম্যাটো ইত্যাদি দিয়ে সালাদ খাবেন, তা হবে না । বউ মুখ ঝামটে উঠলো- জাননা কাঁচা সবজি খেতে মানা ।
কেন? নিরীহ জিজ্ঞাসা আমার ।

কেন মানে ! বউয়ের কণ্ঠে রাগ ঝরে পরে। ‘ওসবে করোনা ভাইরাস থাকতে পারে।’
কি বলছ? ভালো করে ধুয়ে নিলেই তো হল ।- ভয়ে ভয়ে বলা আর কি!
তুমি বেশি জান তাই না? এটা প্রশ্ন নয়, ফাইনাল ডিসিশান।
- ব্যাস চুকলো সালাদ খাওয়া।

সবাই এখন ডাক্তার । কেউ কেউ তো এক ডিগ্রি বেড়ে বিশেষজ্ঞ । যাবতীয় জ্ঞান ওনাদের নখদর্পণে । টোটকা দিচ্ছেন অনেকে। কোথাও কোথাও এসব নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। যেমন সাতটি তুলসী পাতা খেলে করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হবে না- এমন গুজবে গোপালগঞ্জ জেলায় তুলসী পাতা খাওয়ার হিড়িক পড়েছে।

পত্রিকায় পড়লাম গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়াসহ পুরো জেলায় এবার তুলসীপাতা নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে একটি মহল। অনেক আবার ফেসবুকেও তুলসীপাতা খাওয়ার বিষয়ে পোস্ট দিয়েছেন। তবে এর কোন ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন নেওয়াজ মোহাম্মদ।

গত শুক্রবার আমাদের গাছ ভরা তুলসীপাতা দেখেছি। শনিবার ভোরে দেখি তুলসী গাছে কোন পাতা নেই। অনেকে আবার গাছ উপড়ে নিয়ে গেছে- বলেছেন স্থানীয় এক ভুক্তভোগী ব্যাক্তি। এই যখন অবস্থা বাংলাদেশে, তখন প্রতিবেশি ভারতের অবস্থা আরও চমকপ্রদ। একদম আজব তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে ভারতের হিন্দু মহাসভা। সংগঠনের সভাপতি চক্রপাণির তত্ত্ব অনুযায়ী, গরুর গোবর গায়ে মেখে গোমূত্র পান করলেই করোনা ভাইরাস আর থাকবে না।

করোনা ভাইরাস আসলে অবতার। আমিষাশীদের শাস্তি দিতে ও ক্ষুদ্র প্রাণিদের রক্ষা করার জন্যই তিনি পৃথিবীতে আগমন করেছেন; ভগবান নরসিংহ যেমন রাক্ষসদের ধ্বংস করতে ও শিক্ষা দিতে এসেছিলেন। এ থেকে চীনাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত- চক্রপাণির অমোঘ বাণী ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ পায়।
আপনি এসবের প্রতিবাদ করবেন? তাহলেই গেছেন। নাস্তিক থেকে শুরু করে চীন-পাকিস্তানের দালাল পর্যন্ত হয়ে যেতে পারেন।

বাংলাদেশের ফেসবুক করোনা ভাইরাল- এ আক্রান্ত গত কিছুদিন ধরে। ভাইরাল তো নয়, এ যেন আক্ষরিক অর্থেই ভাইরাসের আরেক রূপ। কত রকম পোস্ট যে হতে পারে একটি বিষয়ের উপর– আপনি ফেসবুকে না গেলে কখনো বুঝতে পারবেন না।

কিভাবে মাস্ক লাগাবেন থেকে শুরু করে কিভাবে কোন পদ্ধতিতে হাত ধুবেন, সব এখানে পাবেন। এক পোস্টে ডা. শুভাগত যদি কিছু বলেন আরেক পোস্টে আরও চমকপ্রদ কিছু নিয়ে হাজির ডা. জাহাঙ্গীর।
বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন মিডিয়া হাউসের তৈরি করা নিউজের কপি পেস্ট– এতো হরহামেশা পোস্ট হচ্ছেই। তার উপর আছে নিজস্ব দু'লাইন মতামত। কেউ কেউ জাতীয় অভিভাবক হিসেবে মন্ত্রিদের তো বটেই, প্রধানমন্ত্রীকেও একহাত নিয়ে নেন ।

ভালোই লাগে এসব দেখতে । ইয়োরোপ আমেরিকায় যখন করোনার আক্রমণ– তখন কারো কারো পোস্টে এনিয়ে নির্মল আনন্দের হাওয়া। এ যে নাসারা খ্রিস্টানদের ওপর আল্লাহর গজব। ওদিকে ইরানে একের পর এক মৃত্যু কিংবা সৌদি আরবে এই রোগের প্রভাব থেকে বাঁচতে কাবা শরীফে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা উঠলে – ‘এর প্রয়োজন ছিল ‘।

করোনা ‘বিশ্ব-মহামারি‘ রূপে আবির্ভূত হয়েছে তো কি হয়েছে? মজার কমতি নেই। মাস্কের সরবরাহ বাজারে কমে গেছে, তাই দেখে একজন ছবিসহ পোস্ট দিলো– বিশেষ কায়দায় জাঙ্গিয়া উল্টিয়ে পরে। খারাপ না, নতুনত্ব আছে । আপতকালীন একটা সমাধানও পাওয়া গেলো ।

শুধু তাই নয়, বিবাহিত এবং প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিতদের জন্যেও আপতকালীন সমাধান মজুদ। মেসেঞ্জারে, হোয়াটসআপ–এ সচিত্র সমাধান পৌঁছে যাচ্ছে। করোনার ঝুঁকিবিহীন মিলন। আর কি চাই?

যতই মারমারি ফাটাফাটি, যুদ্ধ বিগ্রহ, রাজনীতি অপরাজনীতি থাকুক না কেন- যতই শ্ত্রুতা হোক না কেন দেশে দেশে– জাতিতে জাতিতে ; অস্তিত্বের প্রশ্নে মানব সম্প্রদায় যে এক হয়ে যেতে পারে কিংবা যায়– তার বড় প্রমাণ আজকের করোনাভাইরাস ।

কে না জানে, চীন আমেরিকার পয়লা সারির দুশমন। কিন্তু আমেরিকার বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লেগেছে এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্যে। জাপানও বসে নেই । ইউরোপে বিভিন্ন দেশের গবেষণাগারে এখন দিনরাত কাজ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বড় অংকের বাজেট ধরেছে, এর নিরাময় খুঁজে নেয়ার জন্য।

সবাই এখন এক হয়ে গেছে। সবকাজ এখন গৌণ হয়ে গেছে। দুনিয়া জুড়ে একটাই শ্লোগান– ঠেকাও করোনা বাঁচাও মানুষ। একে ঠেকানোর উপায় মানুষের জানা হয়ে গেছে। এর প্রতিষেধকও আবিষ্কারের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে মানুষ। সব ঠিক থাকলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাজারজাত হবার সম্ভাবনা ।

এখানেই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের বিশেষত্ব। আর এটাই সত্যি- অস্তিত্ত্ব রক্ষায় মানুষ যখন এক হয়, তখন কারও সাধ্য নেই তাকে হারায় ।

মানুষ কখনো হেরে যেতে পারে না ।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।