রাষ্ট্রের আয়নায় নাগরিক সমাজ : সরকার কি কেবলই জনগণের প্রতিফলন?

ড. রাধেশ্যাম সরকার
ড. রাধেশ্যাম সরকার ড. রাধেশ্যাম সরকার , লেখক: কৃষিবিদ, গবেষক।
প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫

একটি দেশের সরকার কোন পথে এগোবে, সুশাসনের আলোকিত ধারায় নাকি প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অপব্যবস্থাপনার অন্ধকারে, তার উত্তর শুধু রাষ্ট্রের কাঠামো পর্যবেক্ষণ করেই নির্ণয় করা যায় না। কারণ সরকারের প্রকৃতি গঠিত হয় অনেক গভীর স্তরে, যা দৃশ্যমান নীতি-নির্দেশনা বা প্রশাসনিক সাজসজ্জার চেয়েও অধিক ভিত্তিশীল। সেই ভিত্তি হলো দেশের নাগরিকসমাজের চরিত্র, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সামষ্টিক মনোভাব।

যে সমাজে মানুষ ন্যায়বোধে দৃঢ়, শৃঙ্খলা মেনে চলে, সততাকে মূল্য দেয় এবং দায়িত্বকে কর্তব্য হিসেবে ধারণ করে, সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রও স্বাভাবিকভাবেই সুশাসনের পথে এগোয়। প্রশাসন হয় স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনমুখী। বিপরীতে, যেখানে নাগরিকরা নিয়মভঙ্গকে স্বাভাবিক মনে করে, স্বার্থপরতাকে শক্তি ধরে নেয়, দুর্নীতিকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেয় এবং দায়িত্ববোধকে উপেক্ষা করে, সেখানে সরকারও প্রায়শই দুর্বল হয়ে পড়ে; নীতি ভেঙে যায়, শাসনে অস্থিরতা জন্ম নেয় এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা ধীরে ধীরে আস্থাহীন হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্র কেবল প্রশাসনিক কাঠামো নয়; এটি মানুষের অভ্যাস, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবি। সমাজে মানুষের চরিত্র যেভাবে প্রাধান্য পায়, রাষ্ট্রও ঠিক সেই রূপ ধারণ করে। তাই বলা যায়, সরকারের গুণাগুণ নির্ভর করে জনগণের নৈতিক শক্তি ও দায়িত্ববোধের ওপর।

একটি রাষ্ট্র শুধু শাসনব্যবস্থা, প্রশাসন, আইন, আদালত এবং সরকারি নীতি নয়, রাষ্ট্রের সঠিক চালিকাশক্তি হলো মানুষের প্রতিচ্ছবি। যেখানে নাগরিক, সরকারি কর্মচারী, বিচারক, আইনপ্রণেতা এবং সাংবাদিক প্রত্যেকেই মিলে রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি গড়ে তোলে। যেমন- একটি আয়নায় আমরা নিজেকে দেখি, তেমনি রাষ্ট্রও মানুষের আচরণ, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিবিম্ব। যদি আয়নাটি মেঘলা, দাগে ভরা বা ছিদ্রযুক্ত হয়, তাহলে প্রতিচ্ছবিও বিকৃত হবে। রাষ্ট্রও ঠিক সেইভাবে জনগণের নীতি-নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং আদর্শের প্রতিফলন বহন করে। রাষ্ট্রের কার্যকারিতা জনগণের নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতার ওপর নির্ভর করে। যেখানে জনগণ সততা ও ন্যায়পরায়ণ, সেখানে সরকার স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হয়; যেখানে জনগণ স্বার্থপর ও দায়িত্বহীন, সেখানে কাঠামোই কার্যকর হতে ব্যর্থ হয়।

তথ্য বলছে, সু-নাগরিক থাকলে সু-শাসন সম্ভব। বিশ্লেষক ও অর্থনৈতিক গবেষকরা বহুবার দেখিয়েছেন, যে-সব দেশের নাগরিকরা অন্যকে বিশ্বাস করার মানসিকতা রাখে, আইন ও নিয়ম পালনে সচেতন, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ও দায়িত্ববোধকে সম্মান করে, সেই দেশগুলোর সরকার ও প্রশাসনেও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সুশাসন দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন, নরওয়ে এবং জাপানসহ উন্নত দেশ সমূহ। এই উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকরা করদানে স্বচ্ছ, আইন মানে নিয়মিত এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনকে গুরুতরভাবে গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে, সরকারও স্বচ্ছ, জনকল্যাণমুখী এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকে। অন্যদিকে, যে-সব দেশে জনগণ নিয়ম অমান্য করে, করফাঁকি দেয় অথবা স্বার্থপর আচরণকে স্বাভাবিক মনে করে, সেখানে সরকারও দুর্নীতিপ্রবণ, অদক্ষ এবং অব্যবস্থাপন্ন হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে Transparency International Bangladesh (TIB)–র ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, CPI স্কোর ২৩, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। দেশটি ১৮০ দেশের মধ্যে ১৫১তম অবস্থানে রয়েছে। এই স্কোর স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে জনগণের মধ্যে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বার্থপরতা এবং ন্যায়বোধের অভাব কতটা প্রবলভাবে গড়ে উঠেছে। সামাজিক ক্ষেত্রের এই সমস্যাগুলো প্রশাসন, বিচার, সরকারি প্রকল্প এবং বাজেট বরাদ্দ সব জায়গাতেই প্রতিফলিত হচ্ছে।

কিন্তু শুধু তথ্য বা রিপোর্ট নয়, আমরা দৈনন্দিন জীবনে এই বাস্তবতাকে চোখে দেখি। সরকারি অফিসে কাজের সময় স্বাভাবিক নিয়মের পরিবর্তে ছোট বড় সুবিধা অথবা গোপন প্রভাব চালু থাকে। বয়স, দল বা পরিচয় অনুযায়ী পার্থক্য দেখা যায়; আইন বা নিয়মের চেয়ে শক্তিশালী পরিচয় এবং প্রভাবই কার্যকর হয়। সাধারণ মানুষ কর দিতে অনীহা প্রকাশ করে কারণ মনে করে কর দিলে কোনো সুবিধা হবে না। আইন মানার পরিবর্তে নিয়ম ভঙ্গ করা, আর নিয়ম ভাঙার কোনো শাস্তি বা প্রভাব না থাকার অভ্যাস সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ, মামলা, বিচার ধীরগতি সম্পন্ন হয়, আর ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে প্রায়ই কোনো প্রভাব পড়ে না। এইসব অভ্যাসই সমাজকে ধাপে ধাপে দুর্বল, অনাস্থাপূর্ণ এবং অস্থির করে তোলে।

রাষ্ট্র গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত নিজেকে গড়ে তোলা। নিজের চারপাশ, পরিবার, প্রতিবেশী এবং কমিউনিটিতে যেখানে অংশ নেই, সেখানে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আচরণ করতে হবে। যেখানে মানুষ নিজেই পরিবর্তনশীল হবে, সেখানে রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, আইনজীবী, বিচারক এবং সাংবাদিক সবাই স্বয়ং পরিবর্তনপ্রবণ হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত শাসনব্যবস্থা কেবল মানুষেরই আয়না।

মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছেন, দেশের চরিত্রই দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, সরকার ভালো হবে কিনা, তা নির্ভর করে সেই দেশের নাগরিক কতটা ন্যায়বোধে, সততায় এবং দায়িত্বশীলতায় দৃঢ়। ফ্রান্সের বিশ্লেষক এলোনের কথাও প্রাসঙ্গিক, তিনি বলেন, সরকার একটি আয়না; জনগণ যদি অমলিন থাকে, সরকারও অমলিন থাকে। আর যদি জনগণ দুর্নীতিপ্রবণ হয়, সরকারও তা অনায়াসে অনুসরণ করে। এই মননশীল বিশ্লেষণগুলো নির্দেশ করে যে, সরকারের গুণমান ও কার্যকারিতা জনগণের চরিত্র এবং নৈতিক মানের সরাসরি ফলাফল। যদি নাগরিকরা আইন, ন্যায়, দায়বোধ, সততা এবং সামাজিক দায়িত্বের পরিবর্তে স্বার্থ, লোভ, গোপন সুবিধা, আপোস এবং অন্ধ আনুগত্যকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে রাষ্ট্রের অবস্থা ভয়ানকভাবে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়।

সরকারি অফিসগুলো স্বাভাবিকভাবে কার্যকর হতে পারে না, সরকারি প্রকল্পগুলো হয় জটিল ও দুর্নীতিপ্রবণ, উন্নয়ন নয় বরং দুর্নীতির নতুন সুযোগ তৈরি করে। আদালত, প্রশাসন, পুলিশ এবং আইন প্রয়োগকারী সব বিভাগ দায়িত্বহীন হয়ে পড়ে, কারণ সমাজের অধিকাংশ মানুষ একই মনোভাব ধারণ করে। এমন পরিস্থিতিতে ভালো নেতৃত্ব আসতেও ভয় পায়। যারা আইন মেনে চলে, দায়িত্বশীল এবং স্বচ্ছতা চান, তাদের কণ্ঠে বাধা পড়ে কারণ তখনই প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব। আর যারা দল, অর্থ বা পরিচয়ের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসে, তাদের জন্য সরকার কেবল একটি সুবিধা এবং ক্ষমতার ভারী প্রতিপদ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং, জনগণ যদি নিজের মাঝে ন্যায়, সততা এবং দায়িত্ববোধ বজায় না রাখে, তাহলে সরকার কখনোই সত্যিকারের সুশাসিত হতে পারে না।

রাষ্ট্র গঠন হয় মানুষের নৈতিক চরিত্রের ওপর, নাগরিক হল তার ভিত্তি। তাই যারা উন্নত রাষ্ট্র চান, তাদের প্রথম কাজ হলো নিজেকে এবং সমাজকে গড়ে তোলা। শুধু আইন বা নীতিতে বিশ্বাস নয়; হৃদয়ে ন্যায়, মননে দায়িত্ব, আচরণে সততা এবং দৃষ্টিতে দায়বোধ থাকা আবশ্যক। যে-কোনো উন্নতির মূল চালিকাশক্তি ব্যক্তি থেকে জনগণ; ব্যক্তি যদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তখন পুরো জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিবর্তন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, যেখানে মানুষ কর সময়মতো দেয়, সরকারি সেবার জন্য শৃঙ্খলা মেনে চলে এবং অন্যের অধিকারকে সম্মান করে, সেখানেই উন্নয়ন প্রকল্প, সামাজিক ন্যায়, শান্তি এবং সমৃদ্ধি স্থায়ী হয়। এটি কেবল রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে না; প্রতিটি নাগরিককে নিজের জীবন, পরিবার, বন্ধু এবং কমিউনিটির সব স্তরে দায়িত্বশীল হতে হবে।

পরিচ্ছন্ন নাগরিকত্ব হলো সুশাসনের মৌলিক ভিত্তি। রাজনৈতিক আন্দোলন, আইন-নিয়ম এবং প্রশাসনিক সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ হলেও যদি নাগরিকতার ভিতর ফাটল থাকে, তাহলে সেই নীতি, আইন বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে না। একটি স্থির, সৎ, সচেতন ও দায়িত্বশীল সমাজ তৈরি না হলে আইন থাকলেও তা মানা হবে না, আদালত থাকলেও বিচার কার্যকর হবে না, নির্বাচন থাকলেও ভোট স্বার্থভিত্তিক হবে, এবং সরকার থাকলেও ক্ষমতা ব্যবহৃত হবে ব্যক্তিগত স্বার্থ অনুযায়ী। তাই নাগরিকত্ব কেবল পরিচয় নয়; এটি নৈতিক প্রতিজ্ঞা, সামাজিক দায়বোধ এবং প্রতিটি মানুষকে দেশভক্ত হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার।

যদি আমরা সত্যিকারে নাগরিক হিসেবে দায়িত্বশীল হই, তাহলে ধরে নিতে পারি যে আমাদের প্রথম কাজ হলো নিজের চারপাশের ছোট‑ছোট কাজেও সততা, ন্যায় এবং দায়িত্ব বজায় রাখা, যেমন : কর দেওয়া, নিয়ম মানা এবং অপরাধ থেকে বিরত থাকা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা এবং সামাজিক দায়বোধ জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একটি শিক্ষিত সমাজই প্রশ্ন তোলে, অনুসন্ধান করে এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। অবিচার, দুর্নীতি বা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মানসিকতা থাকতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দল নয়, আদর্শকে ভিত্তি করতে হবে। এই কাজগুলো ব্যক্তিগত স্তরেও শুরু করা যায়, কিন্তু যদি সমাজের বড় অংশ এইভাবে সচেতন হয়, তখন তা পরিবর্তনের অঙ্কুর হিসেবে কাজ করবে এবং সেই অঙ্কুর থেকেই নতুন, দায়িত্বশীল এবং সুশাসিত রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।

“জনগণ যেমন, সরকার তেমন” এই বাক্যটি কেবল একটি উপমা নয়, এটি বাস্তবতার স্পষ্ট প্রতিফলন। উন্নত, স্বাধীন এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের জন্য শুধু নীতি বা আইন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সচেতন, দায়িত্বশীল এবং ন্যায়পরায়ণ নাগরিক। জনগণের নৈতিকতা, বিশ্বাস, সক্ষমতা, দায়িত্ববোধ এবং সংহতি সরাসরি সরকারের ন্যায়, সেবা, স্বচ্ছতা এবং জনকল্যাণে রূপান্তরিত হয়। আর যদি জনগণ চরিত্র, ন্যায় এবং দায়বোধ হারায়, তাহলে সরকারের শৃঙ্খলা, সেবা, ন্যায় এবং কার্যকারিতা সবই হারিয়ে যাবে।

এ কারণেই রাষ্ট্র গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত নিজেকে গড়ে তোলা। নিজের চারপাশ, পরিবার, প্রতিবেশী এবং কমিউনিটিতে যেখানে অংশ নেই, সেখানে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আচরণ করতে হবে। যেখানে মানুষ নিজেই পরিবর্তনশীল হবে, সেখানে রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, আইনজীবী, বিচারক এবং সাংবাদিক সবাই স্বয়ং পরিবর্তনপ্রবণ হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত শাসনব্যবস্থা কেবল মানুষেরই আয়না। সুতরাং, যদি আপনি এমন একটি দেশ গড়ে তুলতে চান, যা ন্যায়, স্বাধীনতা, সেবা, স্বচ্ছতা এবং দায়িত্ববোধে সমৃদ্ধ, তাহলে প্রথমে নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে: আমি কি ভালো নাগরিক হয়েছি? যদি না, তাহলে বদলাতে হবে। কারণ জনগণ যেমন, সরকার তেমন।

লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ, গবেষক  ও কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।