এপ্রিলে যেমন-তেমন, মে’তে কী হবে?

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:০৮ এএম, ২৯ এপ্রিল ২০২০

করোনার থাবা থেকে প্রাণে বাঁচতে মানুষের এদিক সেদিক ছোটার কোনো সুযোগ নেই। উন্নত চিকিৎসার জন্য আরেক দেশে চম্পট দেয়া? না, সেই সুযোগ নেই আরও আগে থেকেই। অনেক দেরিতে হলেও সবার বুঝে এসেছে- আমরা কত অসহায়, কত সীমিত, ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র। আমাদের গোটা দুনিয়া ছারখার বা ধ্বংসের অস্ত্রবাজির ক্ষমতা থাকলেও করোনা নামের ক্ষুদ্র ভাইরাসটি দমনের মেডিসিন নেই।

এই বোধের পাশাপাশি প্রশ্ন এসেছে- করোনায় এত প্রাণহানির পর বেঁচে থাকা মানবকুলের কী হবে? প্রশ্নটি কেবল বাংলাদেশে নয়, দেশে দেশে। করোনার ধকল বিশ্ব অর্থনীতিকে যেভাবে বিপর্যস্ত করছে, তাতে পৃথিবীর প্রায় ৫০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হতে পারে বলে সতর্ক করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফাম। করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ধারণাও ভয়াবহ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনার প্রভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকায় শুধু পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে এক কোটি ১০ লাখে দাঁড়াতে পারে।

এ ধরনের শঙ্কা ও ভবিষ্যৎবার্তার মধ্যে বিভিন্ন দেশ যার যার সাধ্যমতো মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ধনী দেশগুলো এ চেষ্টায় এগিয়ে। তাদের কেউ কেউ এরইমধ্যে সামর্থ্যের বাহাদুরীও দেখিয়েছে। এ রকম সংকটে নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রয়োজনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়ার সক্ষমতা তাদের কারও কারও আসলেই রয়েছে। সেই অনুকরণে সক্ষমতা দেখানো শুরু হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেও। পিছিয়ে থাকতে চাচ্ছে না বাংলাদেশও।

করোনায় সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিশাল অংকের প্যাকেজ ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। সরকারি মহলের সব ঠিক আছে, পরিস্থিতি লুকানোর চেষ্টা, ত্রাণ-দান নিয়ে নোংরামি, পোশাক শ্রমিকদের রাওয়ারিশের মতো টেনে আনা, বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের ঘাড়ত্যাড়ামি ইত্যাদি ভয়ংকর পরিণামের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রণোদনা ঘোষণার পর কিছু প্রশ্ন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে। সবকটি প্যাকেজই ঋণনির্ভর।

শিল্প, সেবা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা- এসব খাতে যে অর্থায়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তার সবই ঋণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের দেয়া হবে। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ হারে সুদ পাবে। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক দেবে ঋণগ্রহীতা ও বাকি অর্ধেক ভর্তুকি হিসেবে দেবে সরকার। শঙ্কা হলো, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় কমে গেছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। ব্যাংকগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে তারল্য সংকটের মধ্যে ঋণ দেবে কীভাবে?

ঘোষিত প্রণোদনার মধ্যে আরও সমস্যা হলো, কারা অর্থ পাবেন, যথাযথভাবে প্রণোদনার অর্থ দেয়া হবে কি না- এসব নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পাওয়ার যোগ্যদের পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি আছে? এরইমধ্যে গরীবের ত্রাণ নিয়ে যা চলছে তা উল্লেখ করতেও ঘৃণা হয়। চুরি বা পাচারের পথে ত্রাণ ধরা পড়ার পর সেই ত্রাণে থাবা দিয়েছে হতদরিদ্ররাই। কয়েক জায়গায় তাদের ত্রাণ হরিলুট থামাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে পুলিশকে। এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই বিপদসংকেত।

সামনে কঠিন সময় আসছে- এই বার্তা দেয়া হচ্ছিল বিভিন্ন মহল থেকেই। কিন্তু দৃশ্যত তা আমল দিলেও বাস্তবে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে। সরকারি খুদ-কুড়া খেয়ে তাগড়া হওয়া ব্যক্তি-গোষ্ঠীটি কেবল নিজেরা ভালো থাকলেও হতো। কিন্তু এরা নিজেরা ভালো থাকতে গিয়ে বাদবাকি সবাইকে ধইঞ্চার জায়গায়ও রাখেনি। একেবারে উচ্ছিষ্ট ও ঝুঁকির চরমে ছুড়ে ফেলেছে।

দেশ কানাডা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, ভিক্ষা দেয়ার মতো লোক পাওয়া যায় না- এ ধরনের ভাঁড়ামি বক্তৃতার বিপরীতে দেশে অভাবী মানুষের সংখ্যা কেমন বেড়েছে সেটা এখন প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে। অস্বীকারের সুযোগ থাকলেও লুকোচুরির কোনো সুযোগ নেই। সরকারি দান-ত্রাণ নিয়ে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বেসরকারিভাবে যারা দান-খয়রাতে হাত বাড়িয়েছিলেন তারাও হাতগুটিয়ে নিচ্ছেন। রোজা-রমজানের উছিলায় এ মাসটায় কিছু দান-দক্ষিণা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু পরের মাস মে’তে বিশেষ করে ঈদের পর পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যাবে? ভাবা যায়?

রাজধানীতে হাজার হাজার ফেরিওয়ালা, হকার পুঁজি খেয়ে ফেলেছে। এরাও ত্রাণ খোঁজে। ছোট চাকরিজীবী ও কম আয়ের বহু মানুষ মুখে মাস্ক লাগিয়ে টিসিবির পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক পোশাক কারখানা অর্ডার ক্যানসেলের দোহাই দিয়ে শ্রমিক কমিয়ে এনেছে। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান ভেতরে-ভেতরে অনেক ছাঁটাই করেছে। সেটা সামনে আরও বাড়বে, যা সামনে আরও কঠিন সময়ের বার্তা দিচ্ছে। এরইমধ্যে নগরীর রাস্তায় গায়ে-গতরে সামর্থ্যবান কাউকে দেখলেও চারপাশ থেকে ঘিরে ধরার কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। এরা খুব অদেখা-অপিরিচিত নয়। কদিন আগেও এরা বিভিন্ন দোকান-বাসায় কাজ করেছে। নইলে ছিল রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা বা গ্যারেজের হেলপার-মেকানিক।

ঢাকায় দিন এনে দিন খাওয়া এমন মানুষের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না থাকলেও তা বিশাল বলে ধারণা করা হয়। কেউ কেউ তা ২৫ থেকে ৩০ লাখ বলছেন। কম করে ১০ লাখও হয়ে থাকলে ধীরে ধীরে তারা ভিখারিতে পরিণত হলে কোথায় যাবে সামাজিক চিত্র? তারা কি আদতে ভিখারি থাকবে? চাহিদা না মিটলে আগ্রাসী হয়ে ভিন্ন মূর্তিতে নামবে- যুগে যুগে এটাই সামাজিক নিয়ম। সামনের দিনগুলোতে সেটা কোন পর্যায়ে যাবে, জরুরি ভাবনার বিষয়। ভাবনার সঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপও কাম্য।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।