করোনার মরণথাবা এবং নিয়মরক্ষার নির্বাচন
চীন থেকে যাত্রা শুরু করে করোনাভাইরাসের বিশ্বভ্রমণ অব্যাহত আছে ছয় মাসের বেশি সময় হলো। করোনাভাইরাস মানুষের সামনে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীতে মহামারি এটাই প্রথম নয়। মহামারিতে লক্ষ-কোটি মানুষের মৃত্যুও অতীতে আরও হয়েছে। তারপরও করোনা সারা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে। নাড়িয়ে দিয়েছে রাজনীতি-অর্থনীতি-ব্যক্তিগত জীবনাচারের ভিত। মানুষের সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের গরিমাকে মুখ ভেংচি দিয়ে ব্যঙ্গ করছে, চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে করোনাভাইরাস। ছোট-বড় সব দেশ করোনা নিয়ে মারাত্মক মুসিবতে আছে। কত মানুষের জীবন কেড়ে, মানুষের জীবিকায় কত বড় বিপর্যয় এনে করোনা বিদায় নেবে কিংবা করোনাকে নিয়ন্ত্রণ বা পর্যুদস্ত করা সম্ভব হবে তা এখনও কেউ বলতে পারছে না।
করোনা নিয়ে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা তেমন আশার বাণী শোনাতে পারছে না। তারা যে সতর্কতা জারি করছে তা-ও যথাযথভাবে সব দেশ অনুসরণ করতে পারে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ নিয়েও গবেষণা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস গত ৩ জুলাই বলেছেন, বিভিন্ন দেশে করোনার জন্য পরীক্ষাধীন সম্ভাব্য ওষুধগুলোর কার্যকারিতা দুই সপ্তাহের মধ্যে জানা যেতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারি বিস্তারের শুরু থেকেই কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি ও টিকা নিয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এখন পর্যন্ত ১৮টি সম্ভাব্য টিকা মানুষের ওপর পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি পরিষেবা কর্মসূচির প্রধান মাইক রায়ান বলেছেন, করোনার টিকা কবে আসবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। চলতি বছরের শেষ দিকে হয়তো কার্যকর সম্ভাব্য টিকার নাম জানা যেতে পারে। তবে ব্যাপকভাবে উৎপাদনের পর সে টিকা মানুষের কাছে কবে পৌ্ঁছানো সম্ভব হবে, তা বলা যাচ্ছে না। মাইক রায়ান বিশ্বের সব দেশকে করোনা মোকাবিলায় জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তথ্য মিথ্যা বলছে না। পরিস্থিতি মিথ্যা বলছে না।
এদিকে বাংলাদেশের এক তরুণ গবেষক করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে প্রাথমিক সাফল্যের দাবি করেছেন। ড. আসিফ যদি আবেগতাড়িত হয়ে এই দাবি করে থাকেন, তাহলেও এটা একটি আশা জাগানিয়া ঘটনা। বিশ্বের উন্নত দেশের অত্যাধুনিক গবেষণাগারে নামকরা সব বিজ্ঞানী-গবেষক যেখানে তল পাচ্ছেন না, সেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত গবেষণাগারে পরীক্ষা করে এতবড় সাফল্যের দাবি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে। যারা ড. আসিফের সাফল্যের দাবিকে খাটো করে দেখছেন, তারা কি জানেন হরিপদ কাপালি নামক একজন নিরক্ষর দরিদ্র কৃষক উন্নত ফলনশীল ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন, কোনো রকম গবেষণাগারের সাহায্য ছাড়াই। মানুষের সৃজনপ্রতিভার অমিত সম্ভাবনা নিয়ে বিদ্রুপ করা সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়।
দুই.
করোনা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করলেও সবকিছু একেবারে থামিয়ে দিতে পারেনি। আমেরিকায় একদিকে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, অন্যদিকে পুলিশি নির্যাতনে আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকাজুড়ে হয়েছে বর্ণবাদবিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভ। এরমধ্যেও থেমে নেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি। নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের ফলাফল আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য এক বড় পরীক্ষা বলে মনে করা হচ্ছে। রিপাবলিকান ট্রাম্প, নাকি ডেমোক্রেটিক জো বাইডেন- সেটা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী। জনমত জরিপে এগিয়ে বাইডেন। তবে মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে জোর দিয়ে বলা যায় না যে, জনমত জরিপের ফল ভোটের বাক্সেও প্রতিফলিত হবে।
করোনার ধাক্কা বন্ধ করতে পারেনি আমেরিকা-চীন দ্বন্দ্ব। চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনাও থেমে নেই করোনার কারণে। বাংলাদেশেও করোনা মহামারি জাতীয় সংসদের কয়েকটি আসনে উপনির্বাচন বন্ধ রাখতে পারছে না। সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের কোনো আসন শূন্য ঘোষণার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ভোট করতে হবে। কোনো দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই সময়ে নির্বাচন করা সম্ভব না হলে ৯০ দিন শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিন অর্থাৎ আসন শূন্য হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে।
এই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে জাতীয় সংসদের বগুড়া-১ এবং যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনের দিন ধার্য হয়েছে আগামী ১৪ জুলাই। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আব্দুল মান্নান এবং ইসমত আরা সাদেকের মৃত্যুতে বগুড়া এবং যশোরের দুটি আসন শূন্য হয়। ১৫ এবং ১৮ জুলাই যথাক্রমে বগুড়া এবং যশোর আসন শূন্য হওয়ার ১৮০ দিন পূর্ণ হবে। এর বাইরে আরও তিনটি সংসদীয় আসন শূন্য হয়েছে। এগুলো হলো ঢাকা-৫, পাবনা-৪ এবং সিরাজগঞ্জ-১ আসন। এগুলোতেও ৯০ দিন না হলে ১৮০ দিনের মধ্যে ভোটের আয়োজন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও করোনাকালে ভোটের আয়োজন করা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা কতটুকু চালানো যাবে, সেটাও নিশ্চিত নয়। তবে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। ভোট আমাদের দেশের মানুষের কাছে উৎসবের মতো। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ভোট নিয়ে নানামুখী তর্ক-বিতর্ক হতে থাকায় ভোট আর উৎসবের মেজাজে হয় না। শতকরা কতজন ভোটার ভোট দিলে ভোট গ্রহণযোগ্য হবে, তা নির্দিষ্ট না থাকায় স্বল্প সংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হলেও কোনো সমস্যা নেই।
তাই ভোট নিয়ে যারা ইসিকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা বাস্তবতা থেকে দূরে আছেন। ১৪ জুলাই দুটি আসনে উপনির্বাচন হলে কারও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। আবার আদালতে গিয়ে এটা যদি পিছিয়ে দেয়া হয়, তাহলেও বড় ধরনের জনস্বার্থ রক্ষা হবে বলে মনে করারও কোনো কারণ নেই। যে বিষয়টি শুধু নিয়মরক্ষার জন্য তার শুদ্ধ-অশুদ্ধতা নিয়ে পানি ঘোলা করা অর্থহীন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/বিএ/পিআর