হালে পানি পাবে না, তবে গাধা জল ঘোলা করে খাবে
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা- এই গান এখন আর বাজারে চলে না। তাই মার্কেটে এসেছে নতুন সিডি। সিডির নাম রাজনৈতিক হালাল-হারাম। ভাস্কর্যই মূর্তি, মূর্তিই ভাস্কর্য। মানে এগুলো ধরাছোয়া সব হারাম। এবারের থিমও ফাটাফাটি। তাই এই গান চলবেও কিছুদিন। গানের তালে তালে চলবে পাড়া-মহল্লায় নর্দনকুর্দন, গলা ফাটিয়ে জেহাদ করে নিজেরা শহীদ হয়ে আতেল আর বাতেলদের কাতল করে ভারতে ইসলাম কায়েম করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিছুদিন পর এগুলো আবার কর্পূরের মতো উবে যাবে। যেমনটা গেছে নারী নেতৃত্ব হারাম তত্ত্ব, মরা গরু মরা না মরা কুকুর তত্ত্ব, মসজিদে উলু ধ্বনি তত্ত্ব, বউ তালাক তত্ত্ব ইত্যাদি। একপর্যায়ে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে যারা ফতোয়া দিয়ে জায়েজ করেছিল তারাই হয়তো ভাস্কর্যকে জায়েজ করে দেবে। সবই করবে তবে ঘোলা করে। অতীতেও এমনই ঘটেছে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো-
যেমন- ‘জাতির পিতা অন্য মুসলিম দেশে হলে ঠিক আছে কিন্তু বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হলে বিদ-আত কারণ মুসলমানদের জাতির পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.)’। এবং এ সংক্রান্ত আরো অনেক ফতোয়া দিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে কান্নাকাটি আর তলে তলে বহু ষড়যন্ত্র করেও বিগত সময়ে তাদের হালে পানি পায়নি। কয়েকজন গোড়া আর ধর্ম ব্যবসাজীবী ছাড়া দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় সবাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতার স্বীকৃতি দিয়ে তার আদর্শ সগৌরবে বুকে ধারণ করছে।
এরাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই ছড়া দিয়ে পাকিস্তানি জালেমের পক্ষে ইসলামের অপব্যবহার করেছিল। ‘আল্লাহ বড় মেহেরবান, রক্ষা কর পাকিস্তান’ স্লোগান দিয়ে সে সময় তারা নারী ধর্ষণ, গণহত্যা, লুটতরাজ, ঘরবাড়ি পোড়ানো, সবই হালাল করে নিয়েছিল। তাতে তেমন লাভ হয়নি বরং জাতীয় আন্তর্জাতিক কূটকৌশল, অপতৎপরতা এবং ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে মাত্র ৯ মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যদিও দেশ স্বাধীনের পর কতিপয় লেবাসধারী ইসলামসেবক লন্ডনে বসে মুজিবনগর সরকারের আদলে প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও রক্ষা পরিষদ গঠন করেছিল। এরা মধ্য প্রাচ্যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নামে নানা বিষোদগার করে এখানে ইসলামের নিবিড় চাষকল্পে ব্যাপক ভিক্ষা অনুদান সংগ্রহ করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। পরে এরাই স্বেচ্ছায় নির্বাসন ত্যাগ করে নাকে খত দিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকার করে এর নাগরিকত্ব নিয়েছে।
যখন এলো ’৭১’র রাজাকার আলবদরদের ফাঁসি দেওয়ার পালা তখন ওরা হয়ে গেল ইসলামের সোল এজেন্ট। এই ভণ্ডরা অপরাধী হলেও তারা যেন বিচারের আওতায় না পড়ে দেশে বিদেশে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হলো। এর অংশ হিসেবে বিচারকারীদের উৎখাতের উদ্দেশ্যে গঠিত হলো ইসলাম রক্ষা নামক পরিষদ। এবারও অনেক অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটলো। মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকল। পরিশেষে তাদের ঘটে যখন কোনো সুফলই মিলল না তখন তাদের কেউ ছাদে পালিয়ে গেল, কেউ চাঁদে পালিয়ে গেল আবার কেউ মরণোত্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল।
প্রসঙ্গ গণতন্ত্র না আল্লাহর আইন? এ স্লোগানও বাংলার মানুষ অনেক শুনেছে। স্লোগান শুনতে শুনতে জনগণ যখন ক্লান্ত তখন স্লোগান দিতে দিতেও তারাও ততদিনে তাগুতি গণতন্ত্রের মহান সেবকের খ্যাতি লাভ করতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। মাঝখান দিয়ে বেঘোরে ঝরে গেল কিছু মাস্টারমাইন্ড ও বহু বিভ্রান্ত জিহাদির জীবন।
এক্ষেত্রে পয়লা বৈশাখ পড়েছে মহাবিপদে। কারণ এটি শহরে হালাল আর গ্রামে হারাম। বেশ কয়েক বছর আগেই এর ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামের মসজিদে পয়লা বৈশাখের ঠিক আগের শুক্রবার ইমাম সাব জুমার নামাজে এ হারাম সংক্রান্ত কঠিন খুতবা প্রদান করে থাকবেন। আমার মনে হয় শিগগিরই শহরও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামে গ্রামে পয়লা বৈশাখ হালাল করে দেবে।
মাইকে কথা বলা হারাম- এটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। যদিও মাইকেই অনেক কান্নাকাটি হয়েছে এই মাইক নিষিদ্ধ করার বিষয়ে। আমাদের দেশের আলেম উলামারা এর বেশি ব্যবহার করছে। তারা ওয়াজের মাঝখানে ‘চিল্লাইয়া বলেন ঠিক কি না?’ বলে গর্জে ওঠে। যে এলাকায় ওয়াজ মাহফিল হয় সে এলাকার বাইরেও মাইকে কানেকশন দেওয়া হয়, যাতে সবাই শুনতে পায়। মাইকে বাংলা হিন্দির সবগীতির নকল গান অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে।
এককালে এ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য ইংরেজি বিদ্যাশিক্ষা হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এই হারাম তত্ত্বের অপকারিতা ধীরে ধীরে সবাই টের পেয়েছে। যার মাশুল এখনো গুণতে হচ্ছে। এখন নিজেদের বেশি পণ্ডিত প্রমাণ করতে প্রায়শই ভুলভাল ইংরেজি আওড়াচ্ছেন অনেক আলেম ওলামা। উদাহরণস্বরূপ দরজা খোলা আছে। ওয়াজ মাহফিলের একজন বক্তা এর ইংরেজি বললেন, Is the door open? একটা বিবৃতিমূলক বাক্যকে জানার ভুলে তিনি এক নিমিষেই প্রশ্নবোধক বাক্য বানিয়ে দিলেন। কেন এরকম করলেন? এরা আসলে সবসময় এরকমই করে। কারণ যে কোনো জিনিসকে প্রশ্নবোধক করে তোলাই এদের কাজ।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করার আরেকটি কৌশল হলো জাতীয় সঙ্গীতকে হারাম বলে প্রোপাগান্ডা করে মুসলমানদের মন বিষিয়ে তোলা। এ নিয়ে এখনো কিছু বক্তব্য মাঠে প্রচলিত আছে। কিন্তু আখেরে তেমন লাভ হচ্ছে না। বরং ওরাই লাইন ধরে জাতীয় সঙ্গীত গায়। তবে মনে মনে পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইতে চায়? এই আর কি!
তবে ছবি ওঠা আর শয়তানের বাক্স টিভি দেখা, কেনাবেচা বা ঘরে রাখা হারাম হলেও হারাম ঘোষণাকারী নেতাদের এটা আবার লাগে। কারণ বিভিন্ন চ্যানেলে প্রোগ্রাম থাকে। আবার নারীরা উপস্থাপনা করে। এটা নিয়ে বেশি বলা ঠিক হবে না কারণ এটা হুজুরদের লাগে।
কিছু জিনিস এমনিতেই লাগে আবার কিছু খটকা লাগে। তাই কিছু জিনিস জনগণ মানতে চায় না বা জনগণকে মানানো যায় না। একপর্যায়ে বাংলার নাফরমান- বেদ্বীনদের জাহান্নামে পাঠিয়ে তাদেরই সব মেনে নেওয়া লাগে।
‘তাইলে হুজুর এইরম করেন ক্যা'-
-না মানে কিছু না কিছু তো লাভ আছেই-
‘লাভের আশায় আবার ইহকাল-পরকাল দুইড্যাই হারাইয়েন না হুজুর, রেকর্ড কিন্তু বেশি ভালো না'
লেখক : মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
এইচআর/এমএস