ব্যবসা বনাম মানুষ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ০৫ জুন ২০২১

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বাজেট। করোনা অতিমারির মধ্যে দ্বিতীয় বাজেট। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট গত বৃহস্পতিবার সংসদে উপস্থাপন করেছেন তাতে না আছে স্বাধীনতার ৫০ বছরের কোনো উচ্ছ্বাস না আছে করোনা মহামারি মোকাবিলার কৌশল। ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে আয়ের লক্ষ্য মাত্র ৩ লাখ ৮৯ কোটি টাকা। ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি বাজেট তার ভাষায় জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর বাজেট।

যত দিন যাচ্ছে ততই বাজেটের গুরুত্ব যেন কমছে। একটা হলো সংসদে বাজেট নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হওয়ার কথা তা হয় না। সংসদের বাইরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের যে পরামর্শ গুরুত্ব দেওয়া হতো, সেটা আর দৃশ্যমান নয়। আগে বাজেটের দিন ছিল সরকারের আর্থিক ভাবনা উন্মোচনের দিন। সেদিনই সরকার তার আর্থিক নীতি ঘোষণা করত। কিন্তু এখন গোটা বছর ধরেই নতুন নীতি আসে, বদলায়। এসআরও দিয়ে এনবিআর যা মন চায় করে। তাই বাজেট বক্তৃতার সেই ওজন এখন আর নেই। তবুও বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে হয় এবং হচ্ছে।

অতিমারি পরিস্থিতির জন্য এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়বে এটা অনুমান ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো এবারও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশও ছুঁতে পারেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনা মহামারি রুখতে জরুরি প্রয়োজন হিসেবে বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এ বরাদ্দ কি যারা টিকা নেওয়ার যোগ্য, তাদের চাহিদা মেটাবে? একথাও সত্যি যে, বরাদ্দই আসল নয়। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ যেটুকু দেওয়া হয়েছে সেটা কতটা দুর্নীতিমুক্তভাবে এবং দক্ষতার সাথে খরচ করা হবে তাও গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলো অতিমারির এ পুরো সময়টায় স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয় তা দেখাতে পারেনি।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট শুনে সম্ভবত সবচেয়ে হতাশ ও ব্যথিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। মানুষের কথার চেয়ে বেশি আছে সরকারি চাকুরে আর ব্যবসায়ীদের কথা। আয় কমে গেছে মানুষের, নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ, কিন্তু খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে ব্যবসায়ী সমাজকে। ২০২১-২২ অর্থবছরের নতুন বাজেট প্রস্তাবে করপোরেট করহার কমানো হয়েছে, সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় শিল্পকে। কমেছে ব্যবসায়িক টার্নওভার করহার। এরকম বেশিকিছু উপায়ে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু যে মধ্যবিত্ত গরিব হয়ে গেল তার ভাবনা নেই কোথাও। নতুন গরিব বা আগের গরিব, তাদের কারও হাতেই টাকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই। নেই কর্মসংস্থানের কোনো দিকনির্দেশনা। অর্থমন্ত্রীর ভাবনায় হয়তো আছে যে তিনি বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।

বাজেট প্রস্তাবনায় কাঁচামালের ওপর শুল্ক কমানো আবার শিল্পে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক কিংবা সারচার্জ কমানো, ভ্যাট কমানো হয়েছে। এসব উদ্যোগ শিল্পের বিকাশকে উৎসাহিত করবে। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প, ওষুধ শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, হাঁস-মুরগি-মাছের খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, এদের কলেবর বাড়বে। প্রশ্ন হলো এসব সুযোগ-সুবিধা বড় শিল্পপতিরা যতটা হাতিয়ে নেবে ততটা পারবে না মাঝারি শিল্পপতিরা। অতি ক্ষুদ্র, কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ কোনো কিছু চোখেই পড়েনি। এ বাজেটে মূলত শিল্প বিকাশের থাকলেও তাতে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা কম। একটা কথা বোধহয় ভাবতে হচ্ছে আমাদের যে, সরকারের উদ্যোগগুলো যতটা কিছু ‘ব্যবসায়ী বান্ধব’ হয়, দিনশেষে ততটা ‘ব্যবসা বান্ধব’ থাকে না।

বাজেট প্রস্তাবনায় নারী উদ্যোক্তাদের কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ওপর তাদের কর দিতে হবে না। এ ভাবনা ইতিবাচক। তবে মোবাইল আর্থিক সেবার খরচ যদি বাড়ে, তাহলে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যেসব নারী বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাদের ব্যবসায় ক্ষতি হতে পারে।

নানা জায়গা থেকে বারবার উচ্চারিত হলেও উচ্চ জিডিপির মোহ থেকে মুক্তি ঘটেনি। ছয় লাখ কোটি টাকারও বেশি বিশাল বাজেটে এবার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উচ্চাভিলাষ বজায় রেখেছেন তিনি। করোনার মধ্যে বাস্তবতা বুঝে জিডিপি আলোচনা না করাই যৌক্তিক ছিল বোধ করি।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না রেখে ধন্যবাদ পাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। তবে করোনায় ক্ষতির শিকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কোন কৌশল বোঝা গেল না। সামাজিক নিরাপত্তা খাত, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নে পরিষ্কার কিছু ধারণা পেলাম না। প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার পর ব্যবসায়ী নেতারা স্বাগত জানান। কিন্তু ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ কেন বছরের পর বছর এক জায়গায় আটকে আছে সে নিয়ে তারা কিছু বলেন না।

বাজেটটি যে পরিপ্রেক্ষিতে পেশ করা হলো, তা শতাব্দীর কঠিনতম স্বাস্থ্য ও আর্থিক সঙ্কট। তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজেট হল কিনা সে আলোচনা চলবে। করপোরেটদের বিপুল কর ছাড়, সুবিধা ও প্রণোদনার বিপরীতে সাধারণ মানুষের জন্য কি দিলেন না দিলেন সে আলোচনা এ কয়দিন হয়ে সবাই চুপ মেরে যাবে। আমাদের বাজেট দর্শন ঐতিহাসিক কাল ধরেই এমন।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।