একশ টাকা সাজার অপরাধ নিয়ে এতো লঙ্কাকাণ্ড!

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ১২ আগস্ট ২০২১

করোনা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, নানাবিধ সমস্যায় যখন দেশ জর্জরিত, যখন আগামী দিনগুলোর অনিশ্চয়তায় প্রতিটি মানুষ, তখন ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ভাষায় ‘রাতের রানীদের’ গ্রেফতার করে দেশজুড়ে সৃষ্টি করেছে বড় এক হাঙ্গামার। তবে সপ্তাহ ঘুরতেই ১০ আগস্ট ২০২১, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন যে, রাতের রাজা-রানীদের এহেন কাণ্ডের সাজা মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা। তাও মিলন অবস্থায় হাতে-নাতে ধরা পড়লে। না ধরা পড়লে আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের করার কিছু নেই।

এ কথা শুনে অনেকে তাজ্জব হয়েছেন। তাহলে এতো হাঙ্গামা কেন! কেন পরীমনি-পিয়াসাদের বাড়ি বাড়ি পুলিশি হানা! শুধু কি মদ-মাদক উদ্ধারের জন্য? অন্যদিকে, অনেকে স্বস্তি পেয়েছেন যে, যাক বাবা, বাঁচা গেল। পরীমনি, পিয়াসা, মৌ’র বন্ধু তালিকায় নাম আছে বলে যেই আতংকে বাড়ি ঘরে যাচ্ছেন না, আপাতত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে মান ইজ্জত খোয়ানোর সম্ভাবনা নেই। ডিএমপি কমিশনার তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, কোনো তালিকা তো হচ্ছেই না, তালিকার কথা বলে সাংবাদিক-পুলিশ কেউ চাঁদাবাজির চেষ্টা করলে আমাদের জানান।

পুলিশ কমিশনার সরাসরি বলেছেন, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যে কোনো নাগরিক পারস্পরিক সম্মতিতে সম্পর্কে জড়াতে পারে। যদি তা প্রতারণামূলক না হয় তাহলে পুলিশের তেমন কিছু করার থাকে না। কেউ যদি এমন সম্পর্কের পর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার অভিযোগ না করে তাহলে সেটা দেশের আইনে বড় কোনো অপরাধ বলে গণ্য হবে না। এমনকি আপত্তিকর অবস্থায় কাউকে পেলে মাত্র একশ টাকা জরিমানা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

‘আমি কোথাও অভিযান করে প্রখ্যাত মডেল বা উঁচুদরের মানুষকে আপত্তিকর অবস্থায় পেলাম, তাহলে আমি কী করতে পারি? তাকে ২৯২ এর অধীনে প্রসিকিউশন দিতে পারি জরিমানা ১০০ টাকা। তাও যদি হাতেনাতে ধরতে পারি। আর হাতেনাতে ধরতে না পারলে তো আর কোনো সুযোগ নেই,’ কমিশনার যোগ করেন।

ঘটনাক্রমে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েনের সঙ্গে নায়িকা পরীমনির প্রেম কাহিনিও দেশজুড়ে ঝড় তুলেছে। বিশেষ করে সাকলাইনের জন্মদিনে দু’জনের রোমান্টিক ভঙ্গিতে কেকে কামড়াকামড়ির দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ায় পুলিশের নীতি-নৈতিকতাও প্রশ্নের মুখোমুখি। এ নিয়ে সিসিটিভি ফুটেজের ছবি ও ভিডিও প্রচার করা হয়েছে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমেও। সেখানে বলা হয়, একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে করা মামলার তদারকি কর্মকর্তা থাকার সময় ওই চিত্রনায়িকার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান পুলিশ কর্মকর্তা।

এসব খবরখবর নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে উঠলে সাকলায়েনকে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে বদলি করে দেয়া হয়। তবে সবাইকে অবাক করে সাকলায়েনের সঙ্গে পরীমনির মামলাগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই বলছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেছেন, পরীমনির বোর্ড ক্লাব মামলা তদন্তের দায়িত্ব ঢাকা জেলা পুলিশের, ডিএমপির নয়।

এসব ঘটনায় পুলিশ যে বিব্রত এটা অস্বীকার করেননি শফিক সাহেব। তিনি বলেন, একজন বিসিএস ক্যাডার অফিসার এ ধরনের একটা অনৈতিক সম্পর্কে জড়াবেন, এটি কখনোই প্রত্যাশিত নয়। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ না থাকলেও চাকরি বিধি ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, যেসব অপরাধে নায়িকা-মড়েলদের ধরা হয়েছিল তার মধ্যে এখন অন্যতম অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ঘরে মাদক রাখা। সামাজিক অনাচার, ব্ল্যাকমেইলিং বা অন্য যেসব অপরাধের কথা ধৃত নায়িকা এবং কথিত মডেলদের বিরুদ্ধে শোনা গিয়েছিল, কোনো কিছুই মামলায় আসছে না। কারণ তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কেউ থানা বা কোর্টে মামলা করেনি।

এ জিনিসটা বহুদিন আগে থেকে বলে আসছিলাম যে বাংলাদেশে এক ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যায় যৌন সম্পর্কের আলোচিত ঘটনাবলিতে। অপরাধীর লিঙ্গ টেনেও সুশীল সমাজ থেকে অশিক্ষিত শ্রেণি বিতর্কে লিপ্ত থাকে। সম্পর্কের বৈধতা প্রমাণের জন্য হোটেলে গিয়ে কাবিননামা দাবি করেন পুলিশ। আমি ডিএমপি কমিশনারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই যে, তিনি বহুদিন ধরে জলঘোলা করা একটি বিষয়কে পরিষ্কার করেছেন। মানবাধিকারকে, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তিনি এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে এনেছেন।

অনেক দিন থেকেই এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল যে একটি উঠতি ধনী রাষ্ট্রের জন্য এসব বিষয় খুবই বিপরীতধর্মী। একদিকে আমরা পর্যটনখাতের উন্নতিসহ দেশটিকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র বানাতে চাই, অন্যদিকে কিছু পশ্চাৎপদ ধ্যান ধারণার কারণে দুটি মানুষের চার দেয়ালের মাঝে কোয়ালিটি টাইম ব্যয় করাকে অপরাধ মনে করি এবং তাদের পেছনে পুলিশ অথবা সংঘবদ্ধ জনতা লাগিয়ে দেই।

এখানে গত এপ্রিল মাসের শুরুতে হেফাজত নেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারীসহ বেড়াতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের হামলার মুখে পড়ার বিষয়েও আমার দৃষ্টিভঙ্গি একই। আমি এটাও মনে করি, ইসলামি নেতা নাম দিয়ে তার এসব ধর্মবিরোধী কাণ্ড নিশ্চয়ই তার অনুসারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। ভণ্ডামি। আমি পুলিশকে ধন্যবাদ দেই যে, এ অপরাধে পুলিশ মামুনুলকে গ্রেফতার করেনি, ছেড়ে দিয়েছিল। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সঙ্গে থাকা নারীকে বিয়ের নামে প্রতারণা এবং ভোগ করার অপরাধে। ওই নারীর মামলায়।

তাহলে পরী এবং পিয়াসাদের গ্রেফতারের পেছনে একটাই কারণ এখনও দৃশ্যমান- সেটা হচ্ছে মাদক রাখা। এর আগেও বলেছি, মদ নিয়ে বাংলাদেশের আইন বিতর্কিত এবং বিপরীতধর্মী। দেশে মদ উৎপাদন হয়, আমদানি হয়, বিক্রি হয়। কেউ মদ রাখলে অপরাধ। যে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হচ্ছে সে ব্যক্তি ক্লাবে বা বারে গিয়ে মদ খেতে পারছে। ডাক্তারদের কাছ থেকে ভুয়া সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে লাইসেন্স বানিয়ে অপব্যবহার করছে। কিন্তু সিলেকটিভ অভিযানে পড়ে সে হচ্ছে অপরাধী।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। [email protected]

এইচআর/এমএস/ফারুক

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।