আমরা যদি না জাগি…

ড. হারুন রশীদ
ড. হারুন রশীদ ড. হারুন রশীদ , ডেপুটি এডিটর (জাগো নিউজ)
প্রকাশিত: ০৩:৪২ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২১

চলছে করোনা মহামারিকাল। মানুষজন আছেন গভীর সংকটে। এখন মৃত্যু ও শনাক্তের হার কমলেও পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক নয়। প্রতিদিনই কারও না কারও প্রিয়জন ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। শনাক্ত হচ্ছে হাজার হাজার। অন্যদিকে বিশ্ব পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে আরও সাত হাজার ৪৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে নতুন করে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন সাড়ে চার লাখের বেশি। নতুন করে সুস্থও হয়েছেন চার লাখের বেশি মানুষ। আজ সোমবার (৩০ আগস্ট) সকাল পৌনে ১০টায় আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে করোনার মধ্যেই হানা দিয়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আগস্ট মাসের প্রথম ২৯ দিনে ৩০ জন মারা গেছে। আর দেশে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৪২ জন। গতকাল ২৯ আগস্ট রোববার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। করোনার মধ্য ডেঙ্গুর হানা যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।’

দুই.
ওয়ার্ল্ডোমিটারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৫ লাখ ১৫ হাজার ৫৩ জনে। শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ৭২ লাখ ১৪ হাজার ৮৮৪ জনে। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৯ কোটি ৪১ লাখ ১৪ হাজার ৩৩০ জন। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুতে এখনও বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্তের সংখ্যা তিন কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার ৫১৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ছয় লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৯ জন।

সংক্রমণের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটিতে এখন পর্যন্ত শনাক্তের সংখ্যা তিন কোটি ২৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৬৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন চার লাখ ৩৮ হাজার ৩৮৭ জন। সংক্রমণের ওই তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে শনাক্তের সংখ্যা দুই কোটি ৭ লাখ ৪১ হাজার ৮১৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩০ জন। সংক্রমণের তালিকায় এর পরের স্থানগুলোতে রয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, স্পেন, ইরান, ইতালি।

সংক্রমণের তালিকায় আবারও ২৬ নম্বরে ফিরেছে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত দেশে মোট করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৭ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ২৬ হাজার ১৫ জন। আর করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ১৪ লাখ ১৫ হাজার ৬৯৭ জন।

উল্লেখ করা যায় যে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। দেশটিতে করোনায় প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি। ওই বছরের ১৩ জানুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় থাইল্যান্ডে। সংক্রমণ চীন থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ইউরোপের কিছু দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে দেগুলোতে চলতি বছরের শুরুর দিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসা শুরু হয়। এর বিপরীতে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে ভারতসহ এশিয়ার কিছু দেশে। তবে ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশের অবস্থা আবারও খারাপ হচ্ছে। (সূত্র : জাগো নিউজ ২৯ আগস্ট ২০২১)

তিন.
এটা খুবই উদ্বেগজনক খবর যে রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৫২ জন ভর্তি রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগীর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২০২ জন। গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এবার করোনা মহামারির মধ্যেই ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ৯ হাজার ৮৫৭ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। আর সুস্থ হয়েছে ৮ হাজার ৬৯০ জন।

এদিকে আগস্ট মাসের প্রথম ২৯ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ১৯৯ জন। আগের সাত মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৬৫ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ১২৩ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে। এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ৫৬২ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় এই হাসপাতালে ২১ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। এই হাসপাতালে মারা গেছে ৬ শিশু। (সূত্র : প্রথম আলো ২৯ আগস্ট)

চার.
গত দুই বছর ধরে দেশে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। প্রাণঘাতি রোগটি যারপরনাই দুর্ভাবনার কারণ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। এছাড়া আক্রান্তরা পিঠ, দাঁত, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভব করে। ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে আক্রান্তদের অবস্থার উন্নতি না হলে তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার আগে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়ারও দরকার নেই। চিকিৎসকরা এক্ষেত্রে সচেতনতার কথাও বলেন। বিশেষ করে রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি, কিংবা শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। এডিস মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য দিনের বেলায়ও ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা উচিত।

বাসায় খোলা পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এছাড়া ফুলের টবে জমে থাকা পানি, টায়ারের খোল, ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা অথবা পানির চৌবাচ্চায় এই মশা নির্বিচারে বংশ বিস্তার করে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ১০২ ডিগ্রি ও এরচেয়ে বেশি জ্বর, সঙ্গেই তীব্র মাথা ও শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ে, তীব্র পেট ব্যথা, স্কিন র্যাশ ইত্যাদির সঙ্গে বমিভাব ও ক্ষুদামন্দা থাকলে তার ডেঙ্গু হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এ অবস্থায় অনেকে আতঙ্কিত হয়ে অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানান ধরনের ওষুধ খেয়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর প্রশমনে কেবল প্যারাসিটামল এবং প্রচুর পানি খেলেই চলে। তবে অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে।

বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের প্রধান হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত এক দশকে প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের দুই ভাগই অর্থাৎ ২৫০ কোটি লোক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ৭০ ভাগই এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে বাস করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু, সতর্ক করে দিয়েছে, এখনই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

পাঁচ.
করোনা ও ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে উভয় ক্ষেত্রে সচেতনতাই মূল নিয়ামক। আমাদের জেগে ঘুমালে চলবে না। দায়িত্বশীল গতে হবে নিজেদের জীবনরক্ষার স্বার্থেই। করোনার ক্ষেত্রে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, শারীরিক দূরত্ব মানার মত বিষয়গুলো অত্যন্ত জরুরি। অন্যদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ থকে বাঁচতে হলে এডিশ মশা যাতে বংশ বিস্তার করতে না পারে সে দিকে সচেতন থাকতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, জেলজরিমানা করেও বাসাবাড়ি অফিস-প্রতিষ্ঠানের আশপাশ পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না। অথচ জীবন যাচ্ছে আমাদের। এজন্য মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে আরো সক্রিয় হতে হবে যাতে এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। এ লক্ষ্যে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। মানুষজনকে সচেতন করে তুলতে হবে। করোনা ও ডেঙ্গু দুটি ক্ষেত্রেই মনে রাখতে হবে- ‘প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।’

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।