হিটলারের ধমনিতে কার রক্ত?

ফুরকানুল আলম
ফুরকানুল আলম ফুরকানুল আলম
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ০৮ মে ২০২২

 

জন্মই তার আজন্ম পাপ। অ্যাডলফ হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক। মানবতাবাদী সব মানুষের কাছেই ঘৃণিত এক চরিত্র। তার ধ্বংসের সাড়ে সাত দশক পরও বিশ্বরাজনীতির আলোচনায় আবারো হাজির এই নিষ্ঠুর মানুষটি। তার ইহুদি বিদ্বেষ ইতিহাসের ভয়ংকর সত্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ ইহুদিকে নির্মমভাবে হত্যা করেন হিটলার। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে বাগযুদ্ধ চলছে এই হিটলারের দাদার ইহুদি সত্তার সত্যতা নিয়ে।

গেল পয়লা মে’তে ইতালীয় একটি টিভির 'জোনা বিয়ানকা’ নামে অনুষ্ঠানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গি ল্যাভরভ বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একজন ইহুদী হলেও দেশটির ভেতরে নাৎসিবাদ (হিটলারের আদর্শ) রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি হিটলারের ধমনিতে ছিল ইহুদি সম্প্রদায়ের রক্ত। বিজ্ঞ ইহুদিরা বলেন, সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিসেমিটি (ইহুদি বিদ্বেষী) ব্যক্তিরা ইহুদি হয়ে থাকেন। প্রতিটি পরিবারেই কুলাঙ্গার থাকে।

ল্যাভরভের এই বক্তব্যের পর ফুঁসে উঠেছেন সারা দুনিয়ার ইহুদি ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা। এমন মন্তব্যের জন্য রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী। তবে, ল্যাভরভ তার কথা থেকে সরেননি। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনকে ক্রেমলিন বলছে, নিরস্ত্রীকরণ অভিযান। তাদের দাবি, রাশিয়ার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য এমন অভিযান চালাচ্ছেন ভ্লাদিমির পুতিন। একইসাথে মস্কো বলছে, ইউক্রেনে নাৎসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন রুশ সেনারা।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী অ্যাডলফ হিটলারের শরীরে ‘ইহুদি রক্ত’ ছিল-রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের এমন মন্তব্যের কারণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বৃহস্পতিবার (৫ মে) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা। অবশ্য প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এ কথা বলা হলেও পুতিনের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।

ইউক্রেনে নাৎসিবাদের উত্থান নিয়ে রাশিয়ার এই তত্ত্বের কারণে হিটলার প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছে। কারণ, অ্যাডলফ হিটলারের ব্যক্তিগত আইনজীবী ও তার অন্যতম সহচর হান্স ফ্রাঙ্ক দাবি করেছিলেন, হিটলারের দাদা ইহুদি ছিলেন। ফ্রাঙ্ক তার নিজের আত্মজীবনী ’ইন দ্যা ফেস অভ দ্যা গ্যালৌজ’ বইতে এই তত্ত্বের জন্ম দেন।

১৯৫৩ সালে প্রকাশিত বইতে তিনি দাবি করেন, অ্যাডলফ হিটলারের ধমনিতে ইহুদি রক্তের তথ্য বিষয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল তারই ভাতিজা উইলিয়াম প্যাটট্রিক হিটলার। এতে নিজের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে ফ্রাঙ্ককে দায়িত্ব দেন হিটলার। যাতে তিনি আবিষ্কার করেন, অস্ট্রিয়ার গ্রাজ এলাকায় ফ্রাঙ্কেনবার্গার নামে একটি ইহুদি পরিবারে রান্না-বান্নার কাজ করতেন হিটলারের দাদী মারিয়া আনা শিকলগ্রুবার। ফ্রাঙ্কেনবার্গারের ১৯ বছর বয়সী ছেলের সাথে অবৈধ প্রণয়ে ১৮৩৬ সালে গর্ভবতী হন মারিয়া আনা শিকলগ্রুবার। যাতে জন্ম নেন হিটলারের বাবা অ্যালোইজ হিটলার। জন্মের পর অবৈধ সন্তান হিসেবেই বেড়ে ওঠেন তিনি।

এই দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে ইহুদি পণ্ডিত ও অনেক ইতিহাসবিদ বলছেন, হিটলারের দাদা আসলে ছিলেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান জোহান নেপোমুক হিডলার। বিবাহিত নেপোমুকের অবৈধ সন্তান অ্যালোইজ। তাই বিষয়টি গোপন রাখা হয়। পরে অ্যালোইজের বয়স যখন ৫ বছর। তখন অ্যালোইজের মাকে বিয়ে করেন নেপোমুকের বড় ভাই জোহান জর্জ হিডলার।

এই হিডলার থেকেই হিটলার নামের উৎপত্তি। তবে বছর চারেক পরই অ্যালোইজের মা শিকলগ্রুবার মারা গেলে তার ঠাঁই হয় বায়োলজিক্যাল পিতা নেপোমুকের খামারে। নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে অ্যালোইজকে স্বীকৃতিও দেন জোহান নেপোমুক হিডলার। নেপোমুকের মৃত্যুর দুই দশক পর একজন পাদ্রীকে কোনোভাবে বুঝিয়ে নিজের নামের শেষে হিডলার যোগ করেন। অ্যালোইজ শিকলগ্রুবার থেকে হন অ্যালোইজ হিডলার বা হিটলার। তখন তার বয়স ছিল ৩৯ বছর।

এছাড়া, হিটলারের ডানহাত হান্স ফ্রাঙ্কের বই প্রকাশিত হওয়ার পরপরই জার্মান লেখক নিকোলাস ভন প্রিরাদোভিচ দাবি করেন, ১৮৫০ সালের অগে অস্ট্রিয়ার গ্রাজ এলাকায় কোনো ইহুদী থাকতেন না। ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার ইয়ান কারশোর লেখা হিটলারের জীবনী ‘হিটলার, ১৮৮৯-১৯৩৬: হাবরিস’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। এখানে লেখক দাবি করেন, ফ্রাঙ্কেনবার্গার নামে ওই সময় কোনো ইহুদি পরিবার গ্রাজ এলাকায় থাকতো না। ফ্রাঙ্কেনরেইটার নামে একটি পরিবারের নাম পাওয়া যায়। তবে, তারা ইহুদি ছিলেন না।

তবে, হান্স ফ্রাঙ্কের তত্ত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন মনোবিদ ও চিকিৎসক লিওনার্দ সাক্স। একইসাথে বিরোধীদের যুক্তিও খণ্ডন করেছেন তিনি। ’দি জার্নাল অব ইউরোপিয়ান স্টাডিজ’ সাময়িকীতে রিভিজিটিং দি কোয়েশ্চেন অফ অ্যাডলফ হিটলার্স প্যাটারনাল গ্রান্ডফাদার বা অ্যাডলফ হিটলারের দাদা বিষয়ক প্রশ্নের পুনরালোচনা শিরোনামে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি দাবি করেন, ১৮৫০ এর আগেও অস্ট্রিয়ার স্টিরিয়া প্রদেশে ইহুদিদের বাস ছিল। স্টিরিয়ার রাজধানী গ্রাজ। যা ভিয়েনা মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের সাবেক মেয়র ইমানুয়েল মেন্দেল বাউমগার্টেনের ‘দি জ্যুস ইন স্টিরিয়া: আ হিস্টোরিক্যাল স্কেচ’ বইয়ে রয়েছে।

অস্ট্রিয়ায় ইহুদিদের মধ্যে বাউমগার্টেনই প্রথম কোনো এলাকার মেয়র হন। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত তার ওই বইতে তিনি লেখেন, ১৮৫৬ সালে ইহুদি সহকর্মীদের সাথে নিয়ে স্টিরিয়া প্রদেশের গভর্নর মাইকেল গ্রাফ ভন স্ট্রাসোলদোর সাথে দেখা করেন বাউমগার্টেন। প্রদেশটিতে ইহুদিদের বসবাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন করেন তারা। ওই আবেদনে তারা লেখেন, স্টিরিয়ার জেলাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে থাকছেন ইহুদিরা।

নিজের গবেষণা নিবন্ধে লিওনার্দ সাক্স দাবি করেন, স্টিরিয়ার গভর্নরের সাথে সাক্ষাতের পরই গ্রাজে ইহুদীদের নিবাস আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়। তাই গ্রাজে ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইহুদি কমিউনিটি প্রমাণ করে না, ওই এলাকায় সম্প্রদায়টি এর আগে বাস করেনি। সাক্স দাবি করেন, অধিকাংশ ঐতিহাসিক মিথ্যার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছেন। যার গুরু জার্মান লেখক নিকোলাস ভন প্রিরাদোভিচ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে হিটলারের পূর্বপুরুষ ইহুদি হলেই বা ক্ষতি কী। ঘরের শত্রু বিভীষণের পরিচয় নিয়ে কেন এত দ্বন্দ্ব। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন ইহুদী যারা খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন যেমন, নিকোলাস দোনিন, পল অব বার্গোস বা আলফনসো দে কারতাজেনার মতো লোক তাওরাত পুড়িয়ে ফেলা থেকে শুরু করে জোর করে খ্রিস্টান বানানোর মতো কাজ করেছেন।

এছাড়া, ইহুদিদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও তার সহযোগী রানী ইসাবেলা। তবে, সম্ভবত: ইহুদি জাতির ইতিহাসে হিটলারের মতো এতটা ধ্বংসাত্মক কেউ ছিলেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল এক কোটি ৭০ লাখ। হিটলারের নিধনের কারণে তা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখে। সাড়ে সাত দশক পরও ইহুদি মা-বাবা ঘরে জন্ম নেয়া এবং ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসীদের সংখ্যা ১ কোটি ৪৭ লাখের বেশি নয়।

কারো মা, বাবা বা দাদা ইহুদি; এমন আংশিক শর্ত পূরণ করেও সম্প্রদায়টির দুই কোটির বেশি জনসংখ্যা নেই। মূলধারার ইহুদি সম্প্রদায় আরও দুই দশকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের জনসংখ্যার সমান হতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই যার কারণে বলতে গেলে শত বছরের ক্ষতি হয়েছে; সেই হিটলারের সাথে ইহুদি সম্প্রদায়ের কোনো সম্পৃক্ততা বরদাশত করতে পারবেন না তারা। এটাই স্বাভাবিক।

লেখক: নিউজ এডিটর, চ্যানেল 24।

এইচআর/এমএস

মূলধারার ইহুদি সম্প্রদায় আরও দুই দশকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের জনসংখ্যার সমান হতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই যার কারণে বলতে গেলে শত বছরের ক্ষতি হয়েছে; সেই হিটলারের সাথে ইহুদি সম্প্রদায়ের কোনো সম্পৃক্ততা বরদাশত করতে পারবেন না তারা। এটাই স্বাভাবিক।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।