চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন সফর ও বাংলায় অনূদিত একটি গ্রন্থ

আলিমুল হক
আলিমুল হক আলিমুল হক
প্রকাশিত: ০৯:৪০ এএম, ০৪ আগস্ট ২০২২

 

চীনে আমার দশ বছর পূর্ণ হতে চললো। ২০১২ সালের ১৭ আগস্ট সপরিবারে বেইজিংয়ের মাটিতে পা রাখি আমি। আমাদের আসার প্রায় তিন মাস পর, ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর, দেশটির ক্ষমতাসীন দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সাধারণ সম্পাদক তথা প্রধান নির্বাচিত হন সি চিন পিং। তিনি হলেন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার (১৯৪৯ সালে) পর জন্মগ্রহণকারী প্রথম পার্টিপ্রধান ও সরকারপ্রধান (প্রেসিডেন্ট)।

বিগত দশ বছরে আমি মাত্র মাস-তিনেক চীনের বাইরে কাটিয়েছি। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের দুই মেয়াদের বলতে গেলে পুরোটাই আমি চীনের ভিতরেই ছিলাম (এখনো আছি)। এই দশ বছরে তার নেতৃত্বে চীনের জনগণ যা কিছু অর্জন করেছে এবং তা করতে গিয়ে যত ত্যাগ স্বীকার করেছে, পরিশ্রম করেছে, লড়াই-সংগ্রাম করেছে— তার আমি একজন ক্ষুদ্র সাক্ষী বটে।

সিপিসি’র শীর্ষনেতা নির্বাচিত হওয়ার পর সি চিন পিং প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সামনে এসে বলেছিলেন, ‘জনগণ সুন্দর জীবন চায় এবং আমরা এর জন্যই লড়াই করছি।’ লড়াইয়ের অংশ হিসেবে তিনি পার্টির ভিতরে ও বাইরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেন, সমাজ ও অর্থনীতির সর্বত্র সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করেন, চীনা অর্থনীতিকে বিদেশের জন্য আরও উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন এবং ২০২০ সালের মধ্যে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার আপাত কঠিন লক্ষ্য অর্জনে সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করার নির্দেশনা দেন।

কেউ আশা করেনি যে, সি চিন পিংয়ের শাসনামলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এবং চীনের ওপর না-হক বাণিজ্যযুদ্ধ চাপিয়ে দেবেন; কেউ ভাবেনি যে, কোভিডের মতো মহামারি বিশ্বে আঘাত হানবে এবং তা শুরু হবে খোদ চীনে। বাস্তবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, কোভিডও উহানে আঘাত হেনেছে। কিন্তু চীনা জনগণ বাণিজ্যযুদ্ধে হারেনি; মহামারির কাছেও মাথা নত করেনি। আবার মহামারির আঘাত সামলে নিয়ে, ২০২০ সালের মধ্যে চীন দারিদ্র্যমুক্তও হয়েছে।

সি চিন পিং তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা নেতা। ১৯৬৯ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে, শহুরে জীবনে অভ্যস্ত সি চিন পিং একটি হতদরিদ্র গ্রামে গিয়ে পার্টির পক্ষ থেকে গ্রামবাসীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রায় ৮ বছর তিনি সেই গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে কঠোর কায়িক পরিশ্রম করেছেন, মেধা খাটিয়ে তাদের ভাগ্য উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। ৮ বছর পর যখন তিনি গ্রাম ছেড়ে আসেন, তখন গ্রামবাসী তাকে চোখের জলে বিদায় দিয়েছিল। দরিদ্র সেই গ্রামের বাসিন্দাদের প্রিয় মানুষটা এখন দেশজুড়েই চীনাদের প্রিয় ‘সি দাদা’।

বিগত দশ বছরে কখনো প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ আমার হয়নি, কথাবার্তা বা করমর্দন তো দূরের কথা। ব্যক্তি সি চিন পিংকে বোঝার, তার ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে ভালোভাবে জানার প্রথম সুযোগ আমার হয় একটি অনুবাদগ্রন্থের সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে। বইটির নাম ‘দেশ প্রশাসন’। এই গ্রন্থের তিনটি খণ্ড ইতোমধ্যে বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রতিটি খণ্ড প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার। আমি কাজ করেছি প্রথম খণ্ডটি নিয়ে।

‘দেশ প্রশাসন’ আসলে সি চিন পিংয়ের বিভিন্ন ভাষণ, সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র ও নির্দেশনার সংকলন। এক্ষেত্রে প্রথম খণ্ডটি ধারণ করেছে ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ১৩ জুন পর্যন্ত সময়কালকে। এই খণ্ডটি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের (সিআরআই) বাংলা বিভাগের চীনা সহকর্মীরা বাংলায় অনুবাদ করেন। আমার ওপর বর্তায় সেই অনুবাদকাজের প্রায় ৭০ শতাংশ সম্পাদনার দায়িত্ব। বাকিটুকু সম্পাদনার দায়িত্ব পান সিআরআই-এ আমাদের সাবেক বাংলাদেশি সহকর্মী মোহাম্মদ মহসিন। আনন্দের বিষয়, অনূদিত গ্রন্থটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে।

পাঠকদের অনেকেই জানেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আগামী ৬ আগস্ট দুদিনের সফরে বাংলাদেশে আসবেন। শুনেছি ওই সফরেই সি চিন পিংয়ের ‘দেশ প্রশাসন’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডটির মোড়ক উন্মোচন করবেন তিনি। এতে বাংলাদেশের মানুষ সি চিন পিং সম্পর্কে, তার চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ পাবে।

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন সফরের মূল উদ্দেশ্য শুধু একটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা নয় অবশ্যই। সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হবেন। এসব বৈঠকে ও সাক্ষাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি, একাধিক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যু আলোচিত হবে।

চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বরাবরই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল ও আছে। চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। দুই দেশের বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে চীন বাংলাদেশে রফতানি করে বছরে প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য ও বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ১০০ কোটি ডলারের পণ্য। সাম্প্রতিককালে চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে।

বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের প্রতিকূলে, এ কথা ঠিক। আবার, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ যে দিন দিন বাড়ছে, সেটাও সত্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজে চীনের সরব উপস্থিতি দুই দেশের সুসম্পর্কের নিদর্শন। পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনা কোম্পানি অংশগ্রহণ করেছে; কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করছে। বাংলাদেশকে আট-আটটি মৈত্রীসেতু বানিয়ে দিয়েছে চীন। পদ্মা সেতুর রেলপথ অংশ বাস্তবায়নে মোটা অংকের ঋণও দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। আগারগাঁওয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রটিও চীন-বাংলাদেশ মৈত্রীর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

যতদূর জানি, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের সংখ্যা ২৭টি। এসব চুক্তির বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে ওয়াং ই’র সঙ্গে বাংলাদেশের নেতাদের আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মহামারি ও ইউক্রেন সংকটের কারণে, বিশ্বের বহু দেশের মতো, বাংলাদেশের অর্থনীতিও বর্তমানে চাপের মুখে আছে। এই চাপ কাটিয়ে উঠতে বন্ধুরাষ্ট্র চীন কতোটা ও কীভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে বা করবে, তাও দেখার বিষয়। ওয়াং ই’র সফরের সময় এটি স্পষ্ট হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

দারিদ্র্যবিমোচন খাতে চীনকে মডেল বলা যেতে পারে। জাতিসংঘ যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্য ঠিক করেছে, সেখানে চীন ১০ বছর আগেই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই, পৃথিবীর উন্নয়নশীল অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও এক্ষেত্রে চীনা অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। ওয়াং ই’র সফরে এ বিষয়েও পরামর্শ চাইতে পারে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে ই-কমার্সের ব্যবহার সম্পর্কে চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।

মহামারির কারণে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কয়েক হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী দেশে আটকা পড়ে আছেন বিগত আড়াই বছর ধরে। তাদের শিক্ষাজীবন ইতোমধ্যে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা দ্রুত চীনে তাদের ক্যাম্পাসজীবনে ফিরতে চান।

এদিকে, চীন সম্প্রতি বাংলাদেশিদের জন্য নিজের সীমান্ত উন্মুক্ত করেছে। নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির বাংলাদেশিরা এখন নিয়ম মেনে চীনে ঢুকতে পারবেন। এসব ক্যাটাগরির মধ্যে শিক্ষার্থীরাও আছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত ফ্লাইটের অভাব এবং আকাশচুম্বি বিমানভাড়ার কারণে, অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষেই চীনে ফেরা কঠিন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব। শুনেছি, ওয়াং ই’র আসন্ন সফরে এ প্রসঙ্গও উত্থাপিত হবে। আটকে-পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য বিশেষ ফ্লাইট চালু করতে চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার কথা বলছেন অনেকে।

ওয়াং ই’র সফরে একাধিক আন্তর্জাতিক ইস্যু আলোচিত হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের আগ্রহ বেশি রোহিঙ্গা ইস্যুতে। পাইলট প্রকল্পের আওতায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চায় বাংলাদেশের সরকার। চীনের মধ্যস্থতায়ই এমন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে চলতি মাসেই মিয়ানমার সফর করেছেন ওয়াং ই। দেখার বিষয় তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কী বার্তা নিয়ে ঢাকা যান।

বছরখানেক আগে, ২০২১ সালের জুলাইয়ে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছিল উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে। সেই বৈঠকে ওয়াং ই বলেছিলেন, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে চীন সর্বদা বাংলাদেশের পাশে থাকবে। তিনি আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ চীনের অপছন্দ। ধারণা করা হচ্ছে, ওয়াং ই এবারের সফরে আরেক দফায় এ ব্যাপারে চীনের অবস্থান স্পষ্ট করবেন।

চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তার লেখায় ও বর্ক্তৃতায় প্রায়ই বিভিন্ন চীনা প্রবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। ‘দেশ প্রশাসন’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তার উদ্ধৃত একটি প্রাচীন চীনা প্রবাদ হচ্ছে: ‘কোনো কিছু, এমনকি সাগর ও পর্বতমালাও, অভিন্ন লক্ষ্য ও আদর্শের অনুসারী দুটি জাতিকে আলাদা করতে পারে না ‘ জাতি হিসেবে চীনারা শান্তিপ্রিয়; শান্তিতে বসবাস করাই তাদের লক্ষ্য।

সম্ভবত এ কারণেই প্রাচীনকাল থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী নৌবাহিনী ও স্থলবাহিনী থাকা সত্ত্বেও চীনারা কখনো অন্য কোনো দেশে নিজেদের ঔপনিবেশ স্থাপন করেনি, অন্য কোনো দেশ দখল করেনি। অন্যদিকে জাতি হিসেবে বাঙালিও শান্তিপ্রিয়। এই দুই জাতির মধ্যে, বাঙালি ও চীনা সভ্যতার মধ্যে, দেওয়া-নেওয়ার ইতিহাসও অনেক প্রাচীন, প্রায় তিন হাজার বছরের। মাঝখানে এই দেওয়া-নেওয়ায় ছন্দপতন হয়নি, এমন নয়, হয়েছে, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এটাই আশার কথা।

লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।