দারিদ্র্য দূরীকরণে পদক্ষেপ কী?

মো. মাজেদুল হক
মো. মাজেদুল হক মো. মাজেদুল হক , অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর সদস্য।
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এর অগে রাজনৈতিক সরকার ছিল। রাজনৈতিক সরকারের সময় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ( বিবিএস) নানা কারণে সমালোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের সময় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), বেকারত্বের হার, মূল্যস্ফীতির হার, দারিদ্র্যের হার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

সত্য যে, তথ্যের গরমিল বা বিভ্রাট সবসময় ছিল। তথ্যের গরমিল থাকলে সঠিকভাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেওয়া যায় না। তবে সত্য যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সঠিক তথ্য প্রদান করা হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তীসময় থেকে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। এছাড়াও রাজনৈতিক সরকারের সময় অনেক টাকা ছাপানো হয়েছিল যার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। অনেক শ্বেতহস্তী এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করার কারণেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।

এছাড়াও, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। আমদানি করা পণ্যের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। অনেক পণ্যের জোগান থেকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। এছাড়াও, মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান থাকায় অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। কারণ, মূল্যস্ফীতির হার যে হারে বেড়েছে, সে হারে মজুরিহার বাড়েনি। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে।

মানুষের আয় থেকে ব্যয় বেড়েছে। মানুষের আয়ের ৫৫ শতাংশ ব্যয় করতে হয় খাদ্য কিনতে, চিকিৎসায় ৮ শতাংশ, শিক্ষায় ৮ শতাংশ, যাতায়াতে ৭ শতাংশ এবং পরিষেবায় ৪ শতাংশ। মৌলিক চাহিদা মেটাতে মানুষকে হিমশিম খেতে হয়েছে। বিবিএসের তথ্য মোতাবেক, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরিহার বৃদ্ধি বেশি ছিল। এরপর ৩৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং মজুরি হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

মালয়েশিয়াকে অনুকরণ করে বাংলাদেশ সহজেই দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারে। তবে অর্থনীতি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিগতভাবে এগিয়ে যেতে হবে। কোনোভাবেই যেন খেটে খাওয়া মানুষের প্রকৃত আয় কমে না যায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দেশের শ্রমবাজারের পাশাপাশি বিদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে কমবে দারিদ্র্যের হার। বাড়বে মানুষের জীবনমান। এগিয়ে যাবে অর্থনীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতির গতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এপ্রিল-জুন মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেই মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার মান নেমে যায় এবং দেশের সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে যায়। বাংলাদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হারও বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানুষের জীবনযাত্রা মানের ১১টি মাত্রিকতা নিয়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে সূচকটি গড়ে ওঠে।

বাংলাদেশের জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক প্রতিবেদন বলছে, দেশে ২৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে রয়েছে। ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজ হোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, গত মে মাসে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার ( পিপিআরসি) গবেষণা কাজটি করেছে। ২০২২ সালে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২ সালে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ সেখানে এখন অতি দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫।

এর আগে বিশ্বব্যাংক তার ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ এ আশঙ্কা করেছিল ২০২৫ সালে ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র হবে। এর কারণ হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, বিদ্যমান দুর্বল শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মন্থরগতি। গত অর্থবছর থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ( এডিপি) বাস্তবায়ন আগের তুলনায় অনেক কম ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ খুবই কম। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। গত অর্থবছর ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশের নিচে। চলমান অর্থবছরে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। কাঙ্ক্ষিত ব্যাংকিং সুবিধা না পাওয়ায় উৎপাদন বন্ধ হয়। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলেছে, ব্যাংকিং সমস্যার কারণে প্রায় ৪০০টি পোশাক কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। ফলে মানুষ কাজ হারায়। ফলে মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। ‘জেন্ডারভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলেছে, ২০২৪ -২৫ এর জুলাই-ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে প্রায় ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এর মধ্যে ১৮ লাখ নারী। দুঃখজনক যে, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর্মসংস্থান বাড়েনি। অনেক স্নাতক ডিগ্রিধারী কাজ পাচ্ছে না। বর্তমানে ৯ লাখ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য রেখা দিয়ে দরিদ্র মানুষ চিহ্নিত করা হয়। ক্রয়ক্ষমতা সমতা অনুসারে দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলার আয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অতি দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তবে প্রতিটি দেশের জন্য নিজস্ব একটা দারিদ্র্য রেখা ঠিক করা হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্য সীমার মানদণ্ড হলো খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা ক্রয় করার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা ব্যয় করার সামর্থ্য না থাকলে তিনি দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবেন। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য পরিমাপের ১১৯ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রাখে বিবিএস। এটা সত্য যে, দারিদ্র্য হার কমানোর সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ পুরো বিশ্বে অনুকরণীয়। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস ঢাকায় পালন করেছে বিশ্বব্যাংক। দারিদ্র্য বিমোচন করার পাশাপাশি বাংলাদেশ অনেক আর্থসামাজিক সূচকে এগিয়ে ছিল। যে কারণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য মনোনীত হয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সরকারের একটা পরিকল্পনা থাকে।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। যদিও এখনো নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গ্রহণ করা হয়নি। জাতীয় বাজেট দারিদ্র্য হার কমানোর জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রকৃত গরিবদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সম্ভব হলে বাজেট সংশোধন করে দারিদ্র্য বিমোচনে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। বেশি বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক বন্ধ প্রতিষ্ঠান চালু করা যেতে পারে। বলা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পরে প্রায় ১৫০টি পাট ও বস্ত্রকল জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এখন তা ৫০-এ নেমে এসেছে। এ বন্ধ পাট ও বস্ত্র কলগুলো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে খোলা যেতে পারে। এতে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। রাজশাহী অঞ্চলে বন্ধ রেশম কারখানা রাষ্ট্রের সহায়তায় খুলে দিতে হবে।

দারিদ্র্যবিমোচনে মালয়েশিয়াকে মডেল হিসেবে ধরা যায়। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ১০ বছর পর দেশটির প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা দরিদ্র বলে বিবেচিত হতো। বর্তমানে ১০০ জন মালয়েশিয়ানের মধ্যে মাত্র ছয়জন দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। কারণ, মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণ করা হয়েছে। মালয়েশিয়াকে অনুকরণ করে বাংলাদেশ সহজেই দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারে। তবে অর্থনীতি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিগতভাবে এগিয়ে যেতে হবে। কোনোভাবেই যেন খেটে খাওয়া মানুষের প্রকৃত আয় কমে না যায়। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দেশের শ্রমবাজারের পাশাপাশি বিদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে কমবে দারিদ্র্যের হার। বাড়বে মানুষের জীবনমান। এগিয়ে যাবে অর্থনীতি।

লেখক: চেয়ারম্যান, পলিসি থিংক অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ সেন্টার।

এইচআর/এমএফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।