প্রিয় সুন্দরবন


প্রকাশিত: ০৭:৩৫ এএম, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

আমি কখনো সুন্দরবনে যাইনি, সুন্দরবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানিও না। কিন্তু সুন্দরবনের প্রতি আশৈশব লালন করে এসেছি এক গভীর মমতা। সুন্দরবন আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের সম্পদ বলে নয়, শুধু বন ভালবাসি বলেই সেই ছোটবেলা থেকে ভালবেসে এসেছি সুন্দরবনকেও।

সিলেট শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে চারদিকে বনঘেরা এক পাহাড়ে বড় হয়েছি আমি। মা-বাবার অত্যাচার থেকে পালিয়ে থাকতে, বেড়ে উঠার দিনগুলোর নানান কষ্টে একটুখানি স্বস্তি খুঁজতে ঘন্টার পর ঘন্টা বনের কোন গাছে গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে দোলনা বেঁধে দোল খেয়েছি, সাপের খসে যাওয়া খোলস খুঁজে নিয়ে কাঠি দিয়ে তার দৈর্ঘ মেপেছি, তুকমার বীচি তুলে এনেছি, জংলি পশুপাখির সাথে পাল্লা দিয়ে ফলপাকুড় তুলে খেয়েছি, বনফুল দিয়ে মালা গেঁথে নিজের দিগম্বর দেহ সাজিয়েছি। বন আমার গভীর ভালবাসার জিনিস, আমার আপনতম বন্ধু। আমার অস্তিত্বে মিশে আছে বন।

ছোটবেলা সুন্দরবনের কথা পড়ার সময় আমার মনের চোখে বড় বড় লতাগুল্ম ঝোলানো আকাশছোঁয়া গাছের সারি আর আলো ছায়ার ক্যানপি ভেসে উঠত। ছবিটা সম্ভবত এসেছিল টারজান দেখার অভিজ্ঞতা থেকে। আমার কল্পনার সুন্দরবনে একপাড়া হাঁটলেই একটা বাঘ হালুম করে উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ত, ডালে ডালে ঝুলে বেড়ানো বানরেরা আমাকে তুলে নিয়ে যেত গাছের মগডালে যেখানে রাশিরাশি জংলি ফলের ভিড়ে পাতা দেখা যায় না। আমি ফল তুলে খেতাম আর বানরেরা আমার মাথার উকুন বেছে দিত। মানুষের জঙ্গল থেকে এই কল্পনার জঙ্গল আমার অনেক বেশি প্রিয় ছিল।

সেই থেকে সখ একদিন সুন্দরবনে বেড়াতে যাব, কিন্তু আজো যাওয়া হয়ে উঠেনি। আমার কল্পনার মত হয়তো পাতায় পাতায় ফল, ডালে ডালে বানর অথবা পদে পদে বাঘ কখনোই ছিল না, কিন্তু যতদূর জানি গত কয়েক দশকে মানুষের তৎপরতায় বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। দাসভিত্তিক চিংড়ি চাষ আর উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাতে হাত মিলিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনকে সংকীর্ণতর করে তুলতে।

আর সবশেষে সর্বনাশের কেকে চেরি বসাতে এসেছে রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প। এই চেরি বিষাক্ত না মিষ্ট তাই নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক, জল্পনা কল্পনা। পরিবেশ প্রেমীদের তুখোড় প্রতিবাদের মুখেও কেকের উপরে চেরির অবস্থান অনড় অটল। আমরা অসহায় বনপ্রেমীরা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছি, আমাদের অনিচ্ছুক মুখে বিষাক্ত এই ফল ঠেসে দেয়ার এখন অপেক্ষা শুধু।

আমরা সাধারণ জনতা না হয় তেমন কিছু বুঝিনা তাই  এ বিষয়ে সরকার একের পর এক মন গড়া কাল্পনিক অযৌক্তিক সব তত্ত্ব গেলানোর চেষ্টা করছেন আমাদেরকে, কিন্তু যারা জানেন এবং বুঝেন তাদের সুচিন্তিত তথ্যভিত্তিক মতামতকে অগ্রাহ্য করে এরকম একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে বিকারহীন ভাবে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বারা সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয়, এই সিদ্ধান্তে সরকারের সুবিবেচনার অভাব, প্রধানমন্ত্রীর অযৌক্তিক বক্তব্য এবং তা খন্ডনে প্রকৃত তথ্য সংবলিত প্রচুর ভাল ভাল লেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। অর্থনীতির গূঢ় সব তত্ত্ব এবং তথ্য আমার জানা নেই, আমি রাজনীতিও বুঝিনা। আমি শুধু বুঝি প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে কৃত্রিম সম্পদ তৈরি করার মধ্যে কোন মঙ্গল থাকতে পারে না। জীবনের প্রয়োজনে নগরবাসী হয়েছি কিন্তু বন আজো বড় বেশি টানে, প্রতিটা অবসরে কোথাও কোন বনে ছুটে যাই। বেশি কিছু বুঝি আর না বুঝি, পৃথিবীর যে কোন বন রক্ষার জন্য আমি অন্ধ ভাবে কথা বলব। প্রকৃত ভালবাসা অন্ধই হয়, বনের প্রতি আমার ভালবাসা আমাকে বলে প্রয়োজনে হারিকেন জ্বালিয়েই থাকব, তবু সুন্দরবন ধ্বংসে সায় দেবনা কিছুতেই। রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবাদ আয়োজিত হরতালের সাথে একাত্মতা জানাই।

লেখক : নাট্যকর্মী ও প্রবাসী লেখিকা।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।