বড়দিন: ঘৃণা মুছে হৃদয়ে প্রেম ও ক্ষমা জাগিয়ে তোলার উৎসব

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫০ এএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫

আজকের পৃথিবী এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। একদিকে প্রযুক্তি, জ্ঞান ও বৈশ্বিক যোগাযোগ মানবসভ্যতাকে অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে গেছে; অন্যদিকে যুদ্ধ, সহিংসতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিগত সংঘাত, উদ্বাস্তু সংকট ও নৈতিক অবক্ষয় মানবজীবনকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এই অস্থির ও বিভক্ত বাস্তবতায় বড়দিন—যিশুখ্রিষ্টের জন্মোৎসব ২৫ ডিসেম্বর—কেবল একটি ধর্মীয় স্মরণোৎসব হিসেবে নয়, বরং মানবজাতির জন্য এক গভীর নৈতিক ও মানবিক আহ্বান হিসেবে নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে।

বড়দিনের মূল বার্তা কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আলো, আশা, শান্তি ও মানবিক মর্যাদার এমন এক ভাষা, যা ধর্ম, জাতি ও ভূগোলের সীমা অতিক্রম করে সব মানুষের অন্তরে পৌঁছাতে সক্ষম। প্রভু যিশুর আগমন মানব ইতিহাসে তাই শুধু একটি অতীত ঘটনা নয়; এটি প্রতিটি সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক এক চিরন্তন আলোকযাত্রা।

খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব অনুসারে, যিশু খ্রিষ্টের জন্ম এমন এক সময়ে ঘটেছিল, যখন মানবসমাজ নৈতিক অবক্ষয়, ভয় ও হতাশার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। বাইবেলীয় আখ্যান অনুযায়ী, বেথলেহেমের এক সাধারণ গোশালায় তাঁর জন্ম হয়—রাজপ্রাসাদে নয়, ক্ষমতার অলিন্দে নয়, বরং প্রান্তিক ও অবহেলিত মানুষের পাশে। এই জন্ম নিজেই একটি গভীর প্রতীক: ঈশ্বর মানুষের কাছে এসেছেন মানুষের মতো করেই, মানুষের দুঃখ, বেদনা ও সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হতে। বেথলেহেমের নক্ষত্র যেভাবে পথ দেখিয়েছিল, যিশুর আগমনও তেমনি মানবজাতিকে আলোর পথে আহ্বান জানায়। বড়দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—অন্ধকার যত গভীরই হোক, আলোর সম্ভাবনা কখনো নিঃশেষ হয় না। বর্তমান পৃথিবীতে যখন যুদ্ধের দামামা, পারমাণবিক হুমকি, গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর প্রতিদিনের সংবাদে পরিণত হয়েছে, তখন যিশুর ‘শান্তির দূত’ হিসেবে আগমনের বার্তা নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

যিশুর আগমনের অন্যতম গভীর সার্থকতা হলো মানুষের নৈতিক ও মানবিক মর্যাদার পুনরুদ্ধার। খ্রিষ্টীয় দর্শনে বলা হয়—ঈশ্বর মানুষের রূপ ধারণ করেছেন, যেন মানুষ তার হারানো ঈশ্বরত্ব, অর্থাৎ নৈতিকতা, পবিত্রতা ও মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারে। যিশুর জীবন ও শিক্ষার কেন্দ্রে ছিল ভালোবাসা, ক্ষমা, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগ। তিনি ধনী–দরিদ্র, শাসক–শাসিত, জাত–বর্ণের বিভাজন অস্বীকার করেছেন। সমাজের অস্পৃশ্য, রোগাক্রান্ত, পাপী বলে চিহ্নিত মানুষদের তিনি আপন করে নিয়েছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের ভোগবাদী ও পুঁজিনির্ভর সমাজের জন্য এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। যেখানে মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয় তার সম্পদ, ক্ষমতা বা সামাজিক অবস্থান দিয়ে, সেখানে যিশুর দরিদ্র গোশালায় জন্ম নেওয়ার ঘটনা মানবসভ্যতার জন্য এক নৈতিক প্রতিবাদ। বড়দিন তাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের প্রকৃত সার্থকতা বাহ্যিক জাঁকজমকে নয়, বরং অন্তরের রূপান্তরে। ক্ষমা করতে শেখা, অন্যের কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, অহংকার ভেঙে মানবিক হয়ে ওঠাই বড়দিনের প্রকৃত উদ্যাপন। উপরন্তু যিশুর শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত নৈতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; তা ছিল সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক সুস্পষ্ট আহ্বান। তিনি শিখিয়েছেন— ‘প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।’ এই বাক্যটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী নৈতিক ঘোষণাগুলোর একটি।

যিশুখ্রিষ্টের আগমনের গুরুত্ব কেবল ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক। বড়দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—মানুষ হওয়াই সবচেয়ে বড় ধর্ম। ধর্মের নাম নিয়ে বিভাজন নয়, বরং মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ন্যায়বোধই সভ্যতার প্রকৃত মাপকাঠি। যদি আমরা বড়দিনের আলো দিয়ে নিজেদের হৃদয়ে ক্ষমা, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির প্রদীপ জ্বালাতে পারি, তবেই যিশুর আগমনের প্রকৃত সার্থকতা প্রতিষ্ঠিত হবে। বিভক্ত ও ক্লান্ত এই পৃথিবীর জন্য বড়দিন আজও এক অনিবার্য আহ্বান—আলো বেছে নেওয়ার, মানুষকে বেছে নেওয়ার, এবং শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বড়দিনের এই সামাজিক তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ এক বহুধর্মীয়, বহুসাংস্কৃতিক সমাজ, যেখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান যুগের পর যুগ ধরে একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। এখানে বড়দিন কেবল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি ধীরে ধীরে এক মানবিক ও সামাজিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। মুসলমান প্রতিবেশীর হাতে বড়দিনের কেক তুলে দেওয়া, হিন্দু ও বৌদ্ধ বন্ধুদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, গির্জার প্রার্থনায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতি—এসব দৃশ্য বাংলাদেশে বড়দিনের অনন্য বাস্তবতা। এই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি যিশুর শিক্ষারই বাস্তব প্রতিফলন, যা বিভক্ত বিশ্বে সহাবস্থানের এক শক্তিশালী মডেল হতে পারে।

অর্থাৎ বাংলাদেশে বড়দিনের ইতিহাস কেবল ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসও। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলাদেশ পর্যন্ত বড়দিন ধীরে ধীরে একটি স্থানীয় রূপ লাভ করেছে। “ক্রিসমাস” শব্দটি বাংলায় “বড়দিন” হয়ে ওঠা কেবল ভাষাগত রূপান্তর নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক আত্মীকরণের দৃষ্টান্ত। গ্রামবাংলার গির্জায় মধ্যরাতের প্রার্থনা, পাহাড়ি ও আদিবাসী খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নিজস্ব নৃত্য–গান, শহরের আলোকসজ্জা, কেক–পিঠা ও সামাজিক মিলনমেলা—সব মিলিয়ে বড়দিন বাংলাদেশে এক বহুমাত্রিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই অভিযোজন প্রমাণ করে যে বড়দিন কোনো “বিদেশি উৎসব” নয়; বরং এটি এ দেশের মাটি ও মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

আজকের বিশ্বে বড়দিনের প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এটি কেবল গির্জার আলোকসজ্জা, ক্রিসমাস ট্রি বা উপহারের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকলে তার গভীর অর্থ হারিয়ে যায়। বড়দিন আমাদের ডাক দেয়—ভয়মুক্ত হয়ে মানবিকতা ও ন্যায়ের পথে চলতে। বড়দিনের প্রকৃত সার্থকতা তখনই পূর্ণ হয়, যখন আমরা অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল বা কারাগারে গিয়ে বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াই। যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের জন্য প্রার্থনা করি, শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি দেখাই, কিংবা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠি। যিশুর জীবন আমাদের শেখায়—নীরবতা কখনো কখনো অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর শামিল। বড়দিন তাই আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করে: আমরা কি সত্যিই ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি, নাকি কেবল উৎসবের আড়ম্বরে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি?

পরিশেষে বলা যায়, যিশু খ্রিষ্টের আগমনের গুরুত্ব কেবল ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক। বড়দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—মানুষ হওয়াই সবচেয়ে বড় ধর্ম। ধর্মের নাম নিয়ে বিভাজন নয়, বরং মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ন্যায়বোধই সভ্যতার প্রকৃত মাপকাঠি। যদি আমরা বড়দিনের আলো দিয়ে নিজেদের হৃদয়ে ক্ষমা, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির প্রদীপ জ্বালাতে পারি, তবেই যিশুর আগমনের প্রকৃত সার্থকতা প্রতিষ্ঠিত হবে। বিভক্ত ও ক্লান্ত এই পৃথিবীর জন্য বড়দিন আজও এক অনিবার্য আহ্বান—আলো বেছে নেওয়ার, মানুষকে বেছে নেওয়ার, এবং শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার।

লেখক : সেক্রেটারি, ইক্যুমেনিক্যাল খ্রিষ্টান ট্রাস্ট-ইসিটি, ঢাকা।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।