পাহাড়ের কান্না কি বোধ জাগাবে না?


প্রকাশিত: ০৩:৫৫ এএম, ১৪ জুন ২০১৭

প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্বিচার অত্যাচারের কারণে প্রকৃতি বৈরী হয়ে উঠেছে। ফলে প্রকৃতির মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রতিশোধপরায়ণতা। আর একে প্রতিশোধপরায়ণতাই বা বলি কী করে! পাহাড়ের ওপর থেকে গাছ কেটে, ট্রাকে ট্রাকে মাটি কেটে পাহাড়কে ন্যাড়া করে ফেললে বৃষ্টিবাদলায় তার ধসে পড়া ছাড়া আর কি কোনো উপায় থাকে? আর পাহাড়ের ঢালুর নিচে যেসব অসহায় মানুষ বসতি স্থাপন করে তাদের মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়। দুঃখজনক হচ্ছে এবারো  পাহাড় ধসে কমপক্ষে ১৩২ জন নিহত হয়েছেন। আরো দুঃখজনক হচ্ছে উদ্ধার কাজে গিয়ে উর্ধ্বতন ২ কর্মকর্তাসহ ৪ সেনা সদস্যের মৃত্যু। পাহাড় ধসে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। বস্তুত সেখানে এক মানবিক বিপর্যয়ই দেখা দিয়েছে। রাঙ্গামাটির সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার তৎপরতা এবং অন্যান্য সাহায্য কার্যক্রম চালু রাখতে হবে।

পাহাড় ধসের ঘটনা এই প্রথম নয়। স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। এতে প্রায় ১২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তখন টনক নড়েছিল চট্টগ্রাম প্রশাসনের। এ ঘটনার পর সরকার হাতে নিয়েছিল বেশ কিছু পরিকল্পনা। কিন্তু পরবর্তীতে তার কোনোটির বাস্তবায়ন আর হয়ে ওঠেনি। এরপরও নিয়মিতভাবে পাহাড় ধসে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলেছে। পাহাড় ধসের ঘটনা বারবার কেন ঘটছে? তা তদন্ত করলে বের হয়ে আসে সুবিধভোগী রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিবাণিজ্য। দীর্ঘদিন যাবত চট্টগ্রাম নগরীতে একশ্রেণির রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী পাহাড় কেটে এপার্টমেন্ট তৈরি করার কারণে অল্প বৃষ্টিতে পাহাড়ের পাদদেশ বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ ভূমি দখল নিয়ে আধা-পাকা ঘর নির্মাণ করে ভূমিহীনদের কাছে কমদামে ভাড়া দেয়। এভাবে গত ২০ বছরে চট্টগ্রামে ১১০টি পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও আশ্চর্যজনক হচ্ছে এই পাহাড়েরও মালিক আছে! এই তথাকথিত মালিকরাই পাহাড় কেটে মাটি লুট করে। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় অসহায় মানুষদের থাকতে বাধ্য করে। তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় হয়। এতে রয়েছে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য। সরকার যাবে, সরকার আসবে। কিন্তু পাহাড় দখলকারীদের গায়ে ফুলের টোকা পড়বে না। কারণ যারা দখলদারি চালায় তারা জানে ভাগবাটোয়ারা কোন পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। তাই খোদ সরকারের নির্দেশও কার্যকর হয় না।

চট্টগ্রামের ১২টি পাহাড়কে ভূমিধসের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সরকারিভাবে গঠিত তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও কক্সবাজার পৌরসভার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি আজও। শুধু তা-ই নয়, পাহাড় না কাটার কোনো নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) ও (সংশোধিত) ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারার ৬-খ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না।’ শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয় আইনে পাহাড় কাটার জন্য দুই বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কাটা বা ধসের কারণে শত শত মানুষের জীবন গেলেও এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো নজির নেই।

লাখ লাখ বছরের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই পাহাড়গুলোর বেঁচে থাকাটাও সমান জরুরি। কিন্তু মানুষ তার হিংস্র থাবা বসিয়েছে পাহাড়ের ওপর। বাংলাদেশ এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। তার ওপর পাহাড় কাটার কারণে ভূমিকম্পঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় পাহাড় কাটা বন্ধ না করলে পাহাড়ের কান্নাও বন্ধ হবে না। এবারের ট্র্যাজেডিতে এত মানুষের মৃত্যুর পরও কি টনক নড়বে না?

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।