বজ্রের লাল চোখ: করোনার কালো থাবা

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ০৮ জুন ২০২১

করোনা মহামারিতে মৃত্যুর মিছিলে বাড়তি জোগান দিচ্ছে বজ্রপাত। গত ক’দিন ধরে প্রতিদিনই বজ্র দুর্যোগে মৃত্যুর খবর। একদিকে, করোনা পরিস্থিতি আরো নাজুক হচ্ছে। নানান ভেরিয়েন্ট হানা দিচ্ছে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান বিধিনিষেধ আরো ১০ দিন বাড়িয়ে আগামী ১৬ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এ রকম সময়েই লাশের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে বজ্রপাতে মৃতরা।

আবহাওয়া ও পরিবেশ বিপর্যয়ের জেরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়বে, এমন আভাস দেয়া হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। সেটা ফলতে শুরু করেছে এপ্রিল থেকে। তা বেড়েই চলছে। কোনো কোনোদিন ২০/২২জনের পর্যন্ত প্রাণহানি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বজ্রপাতে এসব মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা মানুষকে নতুন আতঙ্কে ফেলেছে। আবহাওয়াবিদ বা বিশেষজ্ঞদের কাছে বজ্রপাত ঠেকানোর দাওয়াই নেই। আছে সতর্কতার নির্দেশনা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বজ্রঝঝড়ের সময় ঘরের বাইরে না যাওয়া, জরুরি দরকারে বের হলে পায়ে রাবারের জুতা পরা, বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়া, বজ্রপাতের শঙ্কা দেখা দিলে দ্রুত ভবন বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া, ভবনের ছাদ বা উঁচু ভূমিতে না যাওয়া, গাড়ির ভেতর থাকলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ না রাখা ইত্যাদি।
‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ (প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা) ও লাইটেনিং অ্যারেস্টর (বজ্রপাত নিরোধক) স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া যায় বলে জানিয়েছেন দুর্যোগবিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষক-গবেষক অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। এ কাজটি করতে হবে সরকারকেই। বজ্রপাত একটি আকস্মিক ঘটনা। তা নোটিশ দিয়ে আসে না। তাই প্রতিরোধ বা মোকাবেলা আসলেই অসম্ভব। দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে গড়ে দেড় শতের মতো মানুষের মতো মৃত্যু হয়। তবে অংকটা বেড়ে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। বিশেষ করে চলতি বছরের গত ৬ মাসে। সময়টা এমনিতেই সঙ্গীন। লাল চোখে করোনার দাবড়ানি বাড়ছে। এই লালের সঙ্গে ভারতে চলতে থাকা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (কালো ছত্রাক) ভাইরাসটি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার আতঙ্কও ভর করেছে। এমনিতেই গত কিছুদিন ধরে নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট তাড়া করছে।

সর্বশেষ হিসাবে সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর জানায়, দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশে আরেকটি অজানা ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে। আইইডিসিআর এবং আইডিএসএইচআই করোনাভাইরাসের ৫০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সে ৫০টি নমুনার মধ্যে ৪০টিই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। বি.১.৬১৭.২ নামের এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বাইরে রয়েছে সাউথ আফ্রিকান বা বিটা ভ্যারিয়েন্ট। আন-আইডেন্টিফাইড ভ্যারিয়েন্টও রয়েছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। তারা জানিয়েছে, প্রাণঘাতী এই ভ্যারিয়েন্টটি টিকার সুরক্ষাকবচকেও ভাঙার ক্ষমতা রাখে। এমন আতঙ্কজনক অবস্থার মধ্যে বজ্রপাতও মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো পেয়ে বসেছে। এর আগে, বজ্রপাতের ক্ষেত্রে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিল ২০১৬ সাল। ওই বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাত হয়। মারা যান প্রায় ২৬৩ জন। সেই ভয়াবহতার কারণে ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার।

এবার গত ক’দিনের বজ্রপাত ও মৃত্যুসংখ্যা বাজে শঙ্কা দিচ্ছে। দেশে এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে এবং হাওর এলাকায় বেশি বজ্রপাত হয়। কিন্তু, গত ক’দিন হাওর এলাকার বাইরে বজ্রপাত ও মৃত্যুর ঘটনা বেশি। বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য মতে, গত দেড় মাসে বজ্রপাতে মৃত্যু ২’শ প্রায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল এই এগারো বছরে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৯ জন। ২০২০ সালে মারা বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৯৮ জন। তবে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে ২০১৮ সালে, ৩৫৯ জন। ২০১৭ সালে মারা গেছেন ৩০১ জন। ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১১ সালে ১৭৯ জন এবং ২০১০ সালে ১২৩ জন বজ্রপাতে মারা যান।

নানান গবেষণায় প্রমাণ শহরে বজ্রপাত প্রতিরোধে বেশির ভাগ ভবনে প্রতিরোধক দণ্ড রয়েছে। ফলে শহরে মানুষের মৃত্যু কম। কিন্তু গ্রামে, বিশেষ করে ফসলের মাঠে সেই ব্যবস্থা নেই। এ কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি। কেবল হাওর নয়, বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায়ই বৃহত গাছ কমে গেছে। বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটিতে আছড়ে পড়া। বৃক্ষহীন এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচু থাকে। বনভূমি ও উঁচু গাছ কমে যাওয়া ছাড়াও বজ্রপাতে মৃত্যুর আরো কিছু কারণ রয়েছে। তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, প্রচুর মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর রেডিয়েশন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী দখলও বজ্রপাতে মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ। বিশ্বময় তাপমাত্রা পরিবর্তনও সম্পর্কিত।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হিসাব হচ্ছে, বজ্রপাতে একজনের মৃত্যুর সঙ্গে আশেপাশের অন্তত ১০ জন আহত হয়। তাদের প্রায় সবাই স্থায়ীভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ার
শঙ্কা থাকে। আন্তর্জাতিক গবেষণামতে, পৃথিবীর অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয়। সাধারণত আবহাওয়াতে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায় ১২ শতাংশ। ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি আমাদের জন্য কতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, ভাবা যায়?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমকেএইচ

নানান গবেষণায় প্রমাণ শহরে বজ্রপাত প্রতিরোধে বেশির ভাগ ভবনে প্রতিরোধক দণ্ড রয়েছে। ফলে শহরে মানুষের মৃত্যু কম। কিন্তু গ্রামে, বিশেষ করে ফসলের মাঠে সেই ব্যবস্থা নেই। এ কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি। কেবল হাওর নয়, বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায়ই বৃহত গাছ কমে গেছে। বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটিতে আছড়ে পড়া। বৃক্ষহীন এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচু থাকে। বনভূমি ও উঁচু গাছ কমে যাওয়া ছাড়াও বজ্রপাতে মৃত্যুর আরো কিছু কারণ রয়েছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।