নারী দিবসের আলোয়
বিশ্ব নারী দিবস। ৮ মার্চের এই রোদ্র দিনে একটা কথা কেন যে বারবার শুধু মনের গহীনে কান্নার ধ্বনি তুলে হারিয়ে যাচ্ছে কোনো এক নতুন ধারার দারুণ বেদনাঘাতে কি করে বলি সে কথা। নারীর বেদনা ক্ষরণ আর বিষন্নতার কোনো সঙ্গী নেই। এর চেয়ে খাঁটি সত্য কথা আর দ্বিতীয়টি নেই। রক্তক্ষরণে হৃদয়ের ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেলেও তার মুখে সে কথা প্রকাশ করবার অধিকার নেই যেন। কোথায় সে এক দারুণ বাঁধ। শুধু যে রাষ্ট্র সমাজের রক্ত চোখ তাই নয় অন্তরালে আরও আছে এক নির্লিপ্ত ক্লেদ। প্রতিনিয়ত যা ক্ষত বিক্ষত করে নারীর হৃদয় বিচ্ছিন্ন করে তার আবহ আর তোলপাড় করে তার পরিবার বসবাস জীবন-যাপন।
নারীর শোষিত হবার প্রকার ভেদের অভাব নেই। আছে কত কত যে ভিন্ন মাত্রা তার। পুরুষ তাকে কত কত ভাবে যে শোষণ করে তা বুঝি বলবার আর শুনবারও অযোগ্য। এই কথাটিই প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ইতিহাসের প্রথম নারীবাদি ফ্রান্সের পলেইন ডি লা ব্যারে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘পুরুষ কর্তৃক নারী সম্পর্কে যা যা কিছু লেখা আছে, তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে হবে। কারণ এক্ষেত্রে পুরুষ একই সাথে অভিযুক্ত ও বিচারকের আসনে আসীন।’’ সেটা ছিল ১৬৭৩ সালের কথা। আমি এক নিভৃতচারী চারপাশে আজও ২০১৬ তেও কোনো কোনো পুরুষের লেখনিতে দেখতে পাই ব্যারের কথারই প্রকাশ। নারীর কোমল মনের ভালোবাসাকে ব্যবহার করে পুরুষ যারা শিক্ষিতজন-বন্ধু খালাত মামাতো চাচাতো ফুপাতো ভাই স্কুলের শিক্ষক এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়েরও শিক্ষক কবি লেখক কেরানী পিওন রাষ্ট্র সমাজ আর সংসার! কে নেই এই সারিতে।
বিশ্বনারী দিবসের প্রেক্ষাপটটা আসলে ছিল নারীর আর্থিক সচ্ছলতা আর কর্মঘন্টা নির্ধারণের ওপর আলোকিত। তার অধিকার আদায়ের পথটা একেবারেই সরল ছিল না। শুরু হয়েছিল সেই ১৬৪৭ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের মার্গারেট ব্রেন্ট ম্যারিল্যান্ডের অ্যাসেম্বলিতে প্রবেশের দাবি করে বসলেন। সাথে সাথে পুরুষতন্ত্র তা নাকচ করে দিল। এলেন লা ব্যারে। ‘‘ইকুয়াল্টি অব টু সেক্সেস, স্পিচ ফিজিক্যাল এন্ড মোরাল হয়ার ইট ইজ সিন দ্যা ইমপোর্টেন্স টু ডেমোলিশ ইটসেলফ প্রেজুডিস’’ প্রবন্ধটি লিখে সারা ফেললেন। ১৭৯১ সালে ফরাসি নাট্যকার ও বিপ্লবী ওলিম্পে দ্যা গ্রুস নারীকে অবলোকন করাতে চেয়েছিলেন প্রকৃতির শক্তিশালী সাম্রাজ্য মিথ্যা আর পক্ষপাতে দুষ্ট নয়। নিজেকে আবিষ্কার করো। তারই ফলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ফাঁসিতে ঝুলবার আগ মুহূর্তে সেই অদম্য সাহসী বলেছিলেন ‘‘নারীর যদি ফাঁসিতে যাবার অধিকার থাকে তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন?’’
১৭৯২ সালে ইংল্যান্ডের লেখক দার্শনিক ওলস্টনক্রাফট্ ‘‘অ্যা ভিন্ডিকেশন অব দা রাইটস্ অফ ওম্যান’’ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন নারী কোনো যৌনজীব বা ভোগের সামগ্রী নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এম গ্রিম কে (অ্যাঞ্জেলিনা ও সারা) এই নিগ্রো দুই বোন দাসপ্রথা বিলোপ ও নারী অধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ১৮৩৭ সালে আমেরিকায় প্রথম দাসপ্রথা বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরই মাধ্যমে নারীরা প্রথম রাজনীতি করবার সুযোগ পায়। অন্যদিকে নিউইয়র্কে সেলাই কারখানায় চলতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। নারী শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা একদিকে ১৫ ঘণ্টা অপরদিকে তাদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল বিলম্ব উপস্থিতি এমনকি টয়লেটে বেশি সময় ব্যয় করবার জন্যও মজুরি কেটে রাখা হয়। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ প্রথম নিউইয়র্কের শ্রমিকরা কাজের সময় ১০ ঘণ্টা ও উপযুক্ত বেতনের দাবিতে পথে নামেন। এটাই প্রথম নারী আন্দোলন যাতে পুলিশ গুলি করে। এ বছরই জন্ম হয় কারা জেটকিনের। ১৮৭৮ সালে তিনি সিবার ইন্সটিটিউট থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং শিক্ষকতার সনদ পান।
ফরাসী বিপ্লবের অবাধ স্বাধীনতা আর ভাতৃত্বের আদর্শে বিশ্বাসী জার্মানীর ক্লারা জেটকিন এলেন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে। তার সাথে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, অগাস্ট বেবেল, কার্ল লাইভনেখত, রোজা লুক্সেমবার্গ, লেনিনসহ আরও বিশ্বনেতাদের। ১৮৬০ সালে নিউইয়র্কে নারীরা প্রথম দাবি আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়। ১৯০৭ সালে কোপেনহেগেনে আন্তর্জাতিক নারী সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় আর কারা জেটকিন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১০ সালে তিনি কোপেনহেগেনে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দেন। তখন এটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে দাপ্তরিক ভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পটভূমি আর তার সাফল্যগাথা।
যে অমূল্য জীবন নারীকে দিতে হয়েছে তার কর্মক্ষেত্রে মানবিক মূল্যায়নের জন্য তারও বেশি বোধকরি দিতে হয় বেঁচে থেকে প্রতি পদে পদে আজও। রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব নারী দিবস দিয়েছে যোগ্যতা মূল্যায়নের সুযোগ আর যন্ত্রের বাইরে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা, সঠিক মজুরি পাবার অধিকার। কিন্তু অন্তরে যে সুপ্ত একাকীত্ব নিভৃতে যে বন্ধুত্বের আবাস- যেখান থেকে আসবার কথা সকল কাজের প্রেরণা সৃষ্টির উন্মাদনা আর প্রাণ প্রাচুর্য সেখানে পুরুষ রাষ্ট্রযন্ত্র সমাজ খুব নীরবে গোপনে হরণ করছে নারীর যোগ্যতা আর মনুষ্যত্ব। নারী? জানেন কি তা? আজ বোধ হয় ঘুরে দাঁড়াবার সময় এল। নারী দিবসের এই বিশিষ্ট আলোয় নারী কি পারবে নিজেকে এক সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান করে সব দ্বিধা লোকলজ্জা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে করে উঠতে প্রতিবাদ?
সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা আর অগ্রজ সব নারী যোদ্ধাদের জানাই স্যালুট।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী, কবি
এইচআর/পিআর