ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চেতনার রং এখন যেমন
এক বছর আগের এই সময়টা ঢাকার রাজপথে ছিল উত্তাল। ‘জুলাই বিপ্লব’ নামের সেই ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ ছুঁয়ে গিয়েছিল দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি সাধারণ মানুষের হৃদয়েও। রাস্তায় রাস্তায়, দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি ছিল সেই বিক্ষোভের শিল্পিত চিৎকার-তা ছিল একটি সময়ের সাক্ষী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে তখন আঁকা হয়েছিল বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া কিছু কথা, প্রতিবাদের প্রতীক কিছু মুখ, আর স্বাধীনতার চেতনাকে জাগিয়ে তোলার প্রতিচ্ছবি। এক বছর পর, সেই দেয়ালগুলো কেমন আছে? গ্রাফিতিগুলোর রং কি ফিকে হয়ে গেছে? নাকি এখনো চেতনাকে জাগিয়ে তোলে? লেখা: জান্নাত শ্রাবণী; ছবি: মাহবুব আলম
-
২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলো। শুধুই রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এসব ছবির মধ্যে ছিল সময়ের প্রতিচ্ছবি; কখনও নিরস্ত্র ছাত্রের মুখ, কখনও চোখে আগুন জ্বালানো এক তরুণীর চিত্র।
-
সেই ছবিগুলো নিছক আঁকিবুঁকি ছিল না। গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রতিবাদ, অভিমান আর আশা-সব মিলিয়ে এক বিশুদ্ধ শিল্পরূপ নিয়েছিল। অনেকেই এসব ছবি সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন, কেউ পোস্ট করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
-
২০২৫ সালের জুলাইয়ে এসে আমরা ফিরে তাকাই সেই দেয়ালের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা, চারুকলা অনুষদ সংলগ্ন দেয়াল কিংবা কলাভবনের পাশের করিডর-কিছু কিছু জায়গায় এখনও টিকে আছে সেই আঁকা প্রতিবাদ। তবে অনেক জায়গাতেই গ্রাফিতিগুলো বিবর্ণ, ঝাপসা। রোদ, বৃষ্টি আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধূসর হয়ে গেছে অনেক শিল্পকর্ম।
-
তবে কিছু দেয়াল এখনো দৃঢ়ভাবে বহন করে আছে সেই চেতনাকে। কেউ কেউ এগুলো সংরক্ষণে এগিয়েও এসেছেন। চারুকলার কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের উদ্যোগে গ্রাফিতিগুলো রঙ করে তুলেছেন নতুনভাবে, যেন ইতিহাস মুছে না যায়।
-
বলা যায়, এই এক বছরে যেসব দেয়াল মুছে গেছে, সেগুলো আর বাস্তবে নেই, কিন্তু থেকে গেছে অনেকের স্মৃতিতে, ফেসবুক পোস্টে, আর ক্যামেরার ফ্রেমে। অনেক চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক এবং শিক্ষার্থী সেসময়ের গ্রাফিতির ওপর ফটোপ্রজেক্ট চালিয়েছেন। কিছু ছবিকে আর্কাইভ করে রাখা হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও। এই প্রয়াস যেন সময়ের প্রেক্ষাপটে এক ধরনের নীরব শ্রদ্ধা।
-
যেখানে আন্দোলনের চেতনা একসময় রাস্তায় মিশে যায়, সেখানে দেয়ালের গ্রাফিতি হয়ে ওঠে নীরব সাক্ষী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোতে এখনো বেঁচে আছে সেই জুলাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই চেতনা কি শুধু দেয়ালের রঙে সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি নতুন প্রজন্ম এটিকে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যাবে?
-
চারুকলার এক শিক্ষার্থী জানান, ‘এই গ্রাফিতিগুলো শুধুই ছবি নয়, এগুলো আমাদের চেতনার রেকর্ড। আমরা চাই, প্রতি বছর জুলাইয়ে যেন নতুন করে এগুলোর দিকে ফিরে তাকানো হয়। সংরক্ষণ হোক, আলোচনায় থাকুক।’
-
এক বছর আগে যে দেয়ালে লেখা হয়েছিল প্রতিবাদের কবিতা, আজ তা হয়তো কিছুটা বিবর্ণ। তবে চেতনা কি কখনও বিবর্ণ হয়? ‘জুলাই বিপ্লব’ শুধু একটি সময়ের আন্দোলন নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রতিরোধের নাম। সেই প্রতিরোধের নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দেয়ালগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের আঁচে বিবর্ণ হলেও, দেয়ালের রঙে মিশে আছে এক অমলিন ইতিহাস, যা হারিয়ে যাবে না সহজে।