গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাটির ঘর এখন স্মৃতির খাতা ছুঁয়ে বাঁচে
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একসময় গ্রামীণ জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মাটির ঘর। সহজলভ্য উপাদানে নির্মিত এই ঘরগুলো এককালে প্রতিটি গ্রামের চেনা দৃশ্য হলেও এখন তা যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে। আধুনিক নির্মাণশৈলীর দাপটে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য। চোখে পড়ে না আগের মতো সেই মাটির দেয়ালঘেরা শান্তির নিবাস। ছবি: এম মাঈন উদ্দিন
-
স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, দুই দশক আগেও প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় দেখা যেত কাদামাটির দেয়াল ঘেরা এই ঘরগুলো। গরিবের আশ্রয় আর ধনীর শখ দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠত এই ঘর। গ্রীষ্মে শীতল আর শীতে উষ্ণ এই ঘরগুলো ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহজাত মেলবন্ধনের এক অনন্য নিদর্শন।
-
মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সেলিম আজো তার পৈতৃক মাটির ঘরেই বসবাস করছেন। তার ভাষায়, ‘শীত-গ্রীষ্ম দুই ঋতুতেই এই ঘরে আরাম পাওয়া যায়। মাটি দিয়ে তৈরি হওয়ায় এর পরিবেশবান্ধব সৌন্দর্য এবং আরাম উভয়ই আলাদা।’
-
সাধারণত এঁটেল মাটি ভিজিয়ে তা দিয়ে ধাপে ধাপে মজবুত দেয়াল তৈরি করা হতো, যার উচ্চতা একসময় ছুঁত ১০-১২ ফুট পর্যন্ত। পরবর্তীতে চাল কাঠ বা বাঁশের তৈরি ছাউনিতে ঢেকে দেওয়া হতো খড় বা টিন দিয়ে।
-
মজার বিষয় হলো, এই ঘরগুলোর স্থায়িত্ব ছিল শতবর্ষ পর্যন্ত; যদি না কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ তা ভেঙে দেয়। আর গৃহিণীদের হাতে প্রতিনিয়ত কাদা দিয়ে লেপে রাখার কারণে ঘরের সৌন্দর্য টিকে থাকত বছরের পর বছর।
-
তবে দুর্যোগের অভিঘাতে যেমন ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় কিংবা ২০২৪ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা মাটির ঘরের ওপর দারুণ আঘাত হানে। সেসময় বহু ঘর ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেয় মাটির ঘর থেকে।
-
ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলা এবং সময়সাপেক্ষ নির্মাণ প্রক্রিয়া সব মিলিয়ে হারাতে বসেছে এই ঘর নির্মাণের আগ্রহ।
-
একসময় মাটির ঘরকে বলা হতো ‘গরিবের এসি ঘর’। আজ সেই ঘরকেই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। করেরহাট, হিঙ্গুলী, মায়ানী, হাইতকান্দি এবং ওয়াহেদপুরের কোনো কোনো বাড়িতে এখনো দু’একটি মাটির ঘরের অস্তিত্ব টিকে আছে। তবে সংখ্যায় তা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
-
এখন জায়গা করে নিয়েছে পাকা দালান, টিন-সিমেন্টের ঝাঁ চকচকে ঘর। নতুন প্রজন্ম মাটির ঘরের গল্প শুনে হয়তো অবাক হবে, কিংবা ভাববে তা কোনো রূপকথার অংশ। একদিন হয়তো ইতিহাসের পাতায় শুধু থেকে যাবে এই ঘরগুলোর নাম, বাস্তবে নয়।
-
সময়ের তালে পরিবর্তন আসবেই। তবে আক্ষেপ রয়ে যায় এই ভেবে যেখানে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রতিনিয়তই হেরে যাচ্ছে ঐতিহ্য, সেখানে কি আগামী প্রজন্ম কোনোদিন ছুঁতে পারবে না সেই শীতল মাটির দেয়াল?