মানবতার রক্তস্রোতে তৃতীয় লিঙ্গের উদারতা
রক্তের কোনো লিঙ্গ নেই, মানবতারও নয়। যখন বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বিমানের ধ্বংসস্তূপের ধোঁয়ায়, যখন হাসপাতালে দগ্ধ শিশুদের কান্নায় থমকে যায় সময়, তখন সমাজের এক অবহেলিত গোষ্ঠী সামনে এসে দাঁড়ায় নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে। তৃতীয় লিঙ্গের শতাধিক মানুষ এগিয়ে আসেন রক্ত দিতে শুধু একজন মানুষ হিসেবে, একজন সহমর্মী হৃদয় নিয়ে। যাদের দিকে আমরা সাধারণত তাকাই কৌতূহল, ভ্রুকুটি বা দূরত্বের চোখে-তারাই আজ হয়ে উঠেছেন মানবতার প্রতিচ্ছবি। এই ক্ষণের গল্প তাই শুধু দুর্ঘটনার নয়, বরং সামাজিক সংকীর্ণতার গায়ে একটি শক্তিশালী প্রশ্নের ছুরিও। লেখা: জান্নাত শ্রাবণী; ছবি: ইয়াসির আরাফাত
-
ঢাকার উত্তরায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) জনগোষ্ঠীর শতাধিক সদস্য। তাদের মানবিক সহায়তা শুধু একটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নয়, বরং এটি আমাদের সমাজে সেই জনগোষ্ঠীর অবহেলিত অবস্থানের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা। এই ঘটনায় তারা প্রমাণ করেছে যে মানবতা কোন জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সবার উপরে।
-
বেলা পৌনে ১২টার দিকে কুড়িল বিশ্বরোড ও খিলক্ষেত এলাকা থেকে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে এসে উপস্থিত হন। তারা আহতদের জন্য রক্তদান করতে প্রস্তুত ছিলেন এবং নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেন। এটি ছিল একটি অসাধারণ মানবিক উদ্যোগ, যা সমাজের ভিন্ন শ্রেণী বা দল থেকে এসে একটি একীভূত মানবিক ছবি সৃষ্টি করেছে।
-
এই ঘটনার মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের জনগণের মানবিক সহানুভূতি এবং সমাজে তাদের অবদান উঠে এসেছে। তারা সমাজের নানা প্রান্তে অবহেলিত, উপেক্ষিত, এবং প্রায়শই অবমাননা সহকারে জীবনযাপন করে। কিন্তু আজ তারা প্রমাণ করল যে তারা স্রেফ তাদের পরিচয় বা অবস্থার জন্য নির্দিষ্ট নয়, বরং তারা একজন মানবিক প্রজাতি, যারা অন্য মানুষের জন্য সত্যিকার অর্থে চিন্তা করে, সাহায্যের হাত বাড়ায়।
-
তৃতীয় লিঙ্গের জনগণের প্রতি সমাজের এক ধরনের অবহেলা এবং অবমাননার ইতিহাস রয়েছে। তাদের অধিকাংশ সময়ই জনসাধারণের চোখে ঠুনকো, অসহায় কিংবা অদৃশ্য হয়ে থাকে। অথচ, আমরা তাদের মানবিকতার দিক থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। তারা নিজেদের অবহেলিত অবস্থার পরও সহানুভূতির সীমানা ছাড়িয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, যা মানবতার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
-
এটি আমাদের সমাজে একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করে: যদি তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা মানবতার জন্য এই ধরনের উদ্যোগ নিতে পারেন, তবে কেন আমরা তাদের প্রতি এমন আচরণ করি? কেন আমরা তাদের অবহেলা করি, তাদের অধিকার বা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করি?
-
এই উদ্যোগ শুধুমাত্র তাদের স্বার্থে নয়, বরং আমাদের সবার জন্য একটি শিক্ষা। এই উদ্যোগ থেকে প্রমাণিত হয় যে আমাদের সমাজে বিভাজন কাটিয়ে সকল শ্রেণী ও জাতির মানুষকে সম্মান জানানো উচিত। তৃতীয় লিঙ্গের জনগণ, যারা সমাজে সাধারণত নীরব বা অবহেলিত, তাদের আজকের কর্মকাণ্ড কেবল তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতেই নয়, বরং সমাজে মানবতার এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।
-
আমরা সবাই যদি তাদের মতো মানবিক মনোভাব গ্রহণ করতে পারি, তবে আমাদের সমাজ আরও মানবিক, সমানাধিকারভিত্তিক ও সহনশীল হবে।