৫ আগস্ট ভেঙেছিল ক্ষমতার দম্ভ
আগস্টের ওই দুপুরটা আর পাঁচটা দিনের মতো ছিল না। বাতাস ভারী ছিল কান্নায়, রাস্তাগুলো ভিজে ছিল রক্তে আর মানুষের চোখে ছিল বিস্ফোরণের মতো একরাশ সাহস। সেদিন ক্ষমতার চিরস্থায়ী মুখোশ খুলে পড়ে গিয়েছিল জনতার জোয়ারে। রাজার সিংহাসন কেঁপেছিল রাজপথের গর্জনে। যে শাসক ভাবতেন রাষ্ট্র মানেই আমি, আইন মানেই আমার ইচ্ছা। তার সেই অহংকার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল হাজারো অচেনা তরুণের মুখ। যাদের হাতে ছিল না বন্দুক, ছিল রঙতুলি; যাদের মুখে ছিল না রাজনৈতিক ভাষণ, ছিল প্রতিজ্ঞা এই দেশ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কেবল একটি দিন নয়। এটি এমন এক প্রতীক যেদিন ভয় পিছু হটেছিল, সাহস সামনে এসেছিল। রাষ্ট্রপ্রধানের পদত্যাগ নয়, সেদিন ছিল নাগরিক জাগরণের সেই মুহূর্ত যা কেবল ইতিহাসের পাতায় নয়, মানুষের বুকের ভেতর গেঁথে গেছে স্থায়ীভাবে। ছবি: জাগো নিউজ
-
ঢাকার আকাশটা ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা, যেন শহর নিজের নিঃশ্বাস চেপে রেখেছে। সকালটা ছিল অন্যরকম। না, পাখির কূজনে নয়, সেদিন মানুষ জেগেছিল দীর্ঘদিনের নিপীড়নের গ্লানি নিয়ে। আর এই গ্লানিই পরিণত হয়েছিল বিস্ফোরণে এক আগুনঝরা সত্যে, যা দেশের ইতিহাসে অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল।
-
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, একটি দিনের নাম নয়; এটি একটি জাতির ঘুম ভাঙার গল্প, একটি প্রজন্মের ঘাম-রক্তে লেখা প্রতিরোধের উপাখ্যান।
-
শুধু কোটা সংস্কার নয়, এই আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল অপমানিত ছাত্রসমাজের আর্তনাদ থেকে। মাসের পর মাস ধরে চলা নিপীড়ন, বিচারহীনতা আর ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দমননীতি যেন আগ্নেয়গিরির মতো জমেছিল যুব সমাজের বুকে।
-
৪ আগস্ট রাতটা ছিল ভয়াবহ। রাজধানীজুড়ে তাণ্ডব চালানো হয়। ছাত্রাবাসে আগুন, গুম, নিখোঁজ আর গুলিবিদ্ধ লাশের খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু ভয়ের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মানুষের ক্ষোভ।
-
৫ আগস্ট ভোর হতেই শহীদ মিনার থেকে রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত জড়ো হতে থাকে লাখো মুখ। কেউ চোখে অশ্রু, কেউ হাতে ব্যানার।
-
দুপুরে চারদিকে যখন ছড়িয়ে পরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার কথা।
-
মানুষ যেন মুহূর্তেই থমকে যায়, তারপর ফেটে পড়ে বিজয়ের উল্লাসে।
-
কেউ মাটিতে বসে কেঁদে ফেলেন, কেউ ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে শুরু করেন। সেদিন ঢাকার বাতাসে যে কান্না ছিল তা শুধুই শোকের নয়, ছিল মুক্তির।
-
টিএসসি, শাহবাগ, গুলিস্তান চারদিকে মানুষের ঢল। কোনো দলীয় নয়, সেদিন মানুষের হাতে ছিল দেশের লাল-সবুজ পতাকা আর মুখে ছিল একটাই স্লোগান-ভয় পাই না আর, এবার জনতার পালা।
-
এই দিনটির পেছনে ছিল দীর্ঘ দুই দশকের অন্ধকার। গুম, খুন, বিচারহীনতা, দুর্নীতি আর প্রজন্মকে বন্দী করে রাখার অপচেষ্টা। কিন্তু তার ভেতরেই যে আগুন জ্বলছিল, সেটাই একদিন বিস্ফোরিত হবে-তা হয়তো শাসকরাও টের পাননি।
-
৫ আগস্টের আগের রাতেই অনেকে ভেবেছিল আর হয়তো বাঁচবে না। কিন্তু ইতিহাস দেখিয়েছে, বারবার জনতার শক্তি সবচেয়ে ভয়ংকর বন্দুককেও হার মানায়।
-
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কেবল একজন নেত্রীর পতনের দিন নয়। এটি একটি প্রজন্মের প্রতিজ্ঞা, এই দেশ আর কারও কুক্ষিগত নয়। এই দেশ শুধু গুটিকয়েক পরিবারের নয়। এটি ১৬ কোটি মানুষের।