বিপ্লব এসেছিল রং-তুলিতে
ওই সময় কেউ হাতে ধরেনি অস্ত্র, কেউ মুখে দেয়নি আগুনঝরা ভাষণ। তবুও শহর জেগেছিল, দেয়াল রক্তে-রঙে ছুটেছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। পলাশীর মাঠে যেমন তরবারির ঝলক ছিল, জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ তারুণ্যের অস্ত্র ছিল রংতুলির টকটকে আঁচড়। ছবি: মাহবুব আলম
-
একটি রং, একটি কার্টুন-সবকিছু মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল এক নীরব কিন্তু দৃষ্টিকটুভাবে স্পষ্ট বিপ্লব।
-
৫ আগস্টের আগুন শুধু রাজপথেই নয়, জ্বলেছিল দেয়ালেও। সে আগুন ছিল রঙিন, কারণ সেদিন বিপ্লব এসেছিল রং তুলিতে।
-
সে সময় দেশের ছাত্র-তরুণদের হাতে কেবল মোবাইল নয়, উঠে এসেছিল তুলি আর রং-তুলির পাত্র।
-
দেয়াল হয়ে উঠেছিল তাদের ক্যানভাস।
-
আর সেই দেয়ালচিত্রগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে নীরবে, অথচ গর্বভরে।
-
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন ছাত্র আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে, তখন শুধুমাত্র রাস্তায় স্লোগান নয়, এই প্রজন্ম তাদের ভাষা খুঁজে পায় দেয়ালের ছবিতে।
-
তিতুমীর কলেজ, আগারগাঁও, মহাখালী, গুলশান, মেরুল বাড্ডা এই সব জায়গার দেয়াল যেন হয়ে উঠেছিল গণজাগরণের মুখপত্র।
-
ছাত্রদের কেউ চিত্রকলার ছাত্র নয়, কেউ কেউ জীবনে কখনো দেয়ালে কিছু আঁকেননি। কিন্তু সেদিন, কেউ রং কিনে এনেছে, কেউ তুলির পয়সা দিয়েছে, আবার কেউ কাঁধে করে বালতি টেনে এনেছে। রাতভর আঁকা হয়েছে শ্লোগান, মুখচ্ছবি, প্রতীক আর প্রতিবাদের ভাষা।
-
দেয়ালে আঁকা ছিল সাহস আর স্বপ্ন।
-
ছবিগুলোতে চোখ রাখলেই বোঝা যায়-এই গ্রাফিতিগুলো শুধু আঁকা নয়, এ যেন ছাত্র সমাজের চোখের ভাষা।
-
এক ভয়হীন আঠারো বছর বয়সের অগ্নিমুখর উচ্চারণ, যার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে বইয়ের চেয়ে বেশি ছিল স্বপ্ন, প্রতিবাদ আর দেশকে ভালবাসার দায়। জুলাই ২০২৪-এ সেটাই ঘটেছিল।
-
যখন রাষ্ট্রীয় মিডিয়া দমিয়ে রাখছিল আন্দোলনের খবর, তখন ছাত্রদের রং-তুলিই প্রকাশ করেছিল সত্য।
-
২০২৫ সালের আগস্টে দাঁড়িয়ে যখন আমরা পেছনে তাকাই, তখন আশ্চর্য হয়ে দেখি-তিতুমীর কলেজের সেই দেয়াল এখনো রয়েছে, আগারগাঁওয়ের সেই দেয়ালটা এখনও রোদে-জলে টিকে আছে। কেউ কেউ বলে দেয়ালগুলো এখনো নিঃশ্বাস নেয়।
-
প্রাচীন রোমেও দেয়ালে লেখা হতো বিদ্রোহের কথা। বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন পর্যন্ত বারবার দেয়াল হয়ে উঠেছে জনগণের চেতনার আয়না।
-
জুলাই বিপ্লব ছিল এমন এক সময়, যখন ছাত্র-যুবক সমাজ আবার সেই দেয়ালের ভাষাকে ফিরিয়ে এনেছিল। কেউ ক্যাম্পাসে টায়ার পুড়িয়েছিল, কেউ পথে পুলিশের লাঠি খেয়েছিল, আর কেউ দেয়ালে আঁকেছিল এমন কিছু, যা আজও চোখে জল এনে দেয়।
-
আজ সেই গ্রাফিতিগুলো শুধু শিল্প নয়, এটা ইতিহাস। সেগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। এগুলো পেইন্ট করে ঢেকে ফেলা মানে জনতার স্মৃতি মুছে ফেলা।
-
শিল্পীরা বলেন, দেয়ালচিত্র ক্যানভাসের চেয়ে বেশি শক্তিশালী, কারণ এটা সবার চোখে পড়ে, কেউ চাইলে না চাইলেও পড়ে। আর তাই এই গ্রাফিতিগুলো শুধুই ছবি নয়, এ এক জাতীয় চেতনার রঙিন দলিল।
-
জুলাই বিপ্লবের সময় যারা হাতে তুলির বদলে মাইক্রোফোন, গুলি বা বুলেট ধরেছিল, তারা সময়ের পাতায় কালিমা হয়ে গেছে। কিন্তু যারা রঙ তুলে নিয়েছিল, তাদের ছবিগুলো আজ দেশের গর্ব।
-
দেয়ালের ভাষা নীরব, কিন্তু তাদের চিৎকার শুনতে পায় সময়। ৫ আগস্টের সাহসিকতার পাশে দাঁড়িয়ে, এই দেয়ালচিত্রগুলো বলছে, ‘আমরা হারাইনি, আমরা আজও রঙে বেঁচে আছি।’