লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসে ভক্তদের মিলনমেলা
বাংলার মাটিতে যে কণ্ঠে মানুষ খুঁজেছে মানুষকে, ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ভুলে যে মন ছুঁয়েছে মানবতার গভীরে-তিনি লালন সাঁই। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়া আজও তার সেই চিরন্তন দর্শনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি বছর তার তিরোধান দিবস ঘিরে ছেউরিয়া যেন হয়ে ওঠে এক অপার্থিব মেলাঘর, যেখানে গান, ধ্যান, ভালোবাসা আর মানবতার সুরে মিশে যায় পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত মানুষেরা। ছবি: মাহবুব আলম
-
এবার পালিত হচ্ছে লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস। সকাল থেকেই কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় ভক্ত, অনুসারী আর দর্শনার্থীদের ঢল নামে।
-
কারও হাতে দোতারার সুর, কেউ আবার নিঃশব্দে বসে আছে মাজারের সামনে, চোখে গভীর শান্তি। বাতাসে ভেসে বেড়ায়, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’-এই চিরন্তন বাণীর প্রতিধ্বনি।
-
ছেউরিয়ার আখড়ায় আজ শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটা এক মানবতার উৎসব। সাদা পোশাকে, গলায় মালা, মাথায় গামছা বেঁধে ভক্তরা আসছেন দূরদূরান্ত থেকে। কেউ কুষ্টিয়া শহর থেকে, কেউ রাজশাহী বা ফরিদপুর, কেউ আবার ভারতের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম থেকেও।
-
প্রত্যেকে এসেছেন একটিই তাগিদে-লালনের দর্শনকে ছুঁয়ে দেখার, সেই সুরে নিজের অস্তিত্ব মেলানোর। মেলার মাঠে তখন গানের ঢেউ, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়…’
-
একজন গেয়ে ওঠেন আর আশেপাশে বসে থাকা শত মানুষ একসঙ্গে গলা মেলায়। কণ্ঠে কণ্ঠে মিলেমিশে যায় ভক্তি আর ভাবের মাধুর্য।
-
লালন শুধু গান লেখেননি-তিনি গানের ভেতর দিয়েই মানুষকে চিনতে শিখিয়েছেন। তার প্রতিটি বাউলগান যেন একেকটা দর্শনের পাঠশালা।
-
‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে…’-এই গান যখন বাজে মেলায়, তখন বোঝা যায় লালনের দর্শন কোনো ধর্মের বাঁধনে বন্দি নয়। এটা এক সর্বজনীন মানবতাবাদ, যেখানে মানুষই ধর্ম, প্রেমই জীবন।
-
মেলা প্রাঙ্গণে বসেছে বাউলদের আড্ডা। কেউ দোতারা বাজাচ্ছেন, কেউ একতারা। কেউ আবার ধীরস্বরে তত্ত্বকথা বলছেন তরুণ অনুসারীদের। সেই কথায় উঠে আসে জীবন মানে খুঁজে পাওয়া নয়, খোঁজার আনন্দে থাকা।
-
গানের স্রোতের বাইরে আখড়ার ভেতর মাজার প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে আছে এক গভীর নীরবতা। ভক্তরা নিরবে এসে দাঁড়ান, কারও চোখে জল, কারও ঠোঁটে সুর। ধূপের ধোঁয়া আর ফুলের গন্ধে ভরে যায় চারপাশ। মনে হয়, লালনের আত্মা যেন এখনো এই বাতাসে ভাসছে, এখনো সে গান গেয়ে যাচ্ছে, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, তবু সুখে থাকো মন।’
-
এই প্রার্থনা, এই শ্রদ্ধা যেন এক ভেতরের শান্তি এনে দেয় প্রতিটি আগত মানুষের মনে।
-
দিনভর চলে সুফি ও বাউল দর্শনের আলোচনা। প্রবীণ ফকির ও সাধুরা ব্যাখ্যা দেন লালনের মানবধর্ম, তার আত্মদর্শন ও সামাজিক চেতনা নিয়ে। তারা বলেন, লালন সাঁই ছিলেন ধর্মীয় প্রথার বাইরের এক মুক্ত আত্মা। তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন, ‘মানুষই যদি মানুষকে না চেনে, তবে আল্লাহ বা ভগবানকে চেনা অসম্ভব।’
-
এই বয়ানে তরুণরা যেমন অনুপ্রাণিত হয়, তেমনি প্রবীণরা ফিরে পান অতীতের স্মৃতি। একদিকে গানের সুর, অন্যদিকে তত্ত্বের ব্যাখ্যা-দুই মিলেই ছেউরিয়ার আখড়া হয়ে ওঠে এক আধ্যাত্মিক একতান।