শেষ হলো হাল্ক হোগানের বিতর্কে মোড়া জীবন
বিতর্ক যেন তার ছায়াসঙ্গী ছিল। একাধিক বিয়ে, ব্যক্তিগত মুহূর্ত ফাঁস হয়ে যাওয়া, কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান; সব কিছুর মাঝেও একটিই জিনিসে অটল ছিলেন তিনি-পেশাদার কুস্তির প্রতি ভালোবাসা। সেই কুস্তিকেই বিশ্বজুড়ে বিনোদনের অন্যতম জনপ্রিয় শাখায় পরিণত করতে যার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য, সেই হাল্ক হোগান চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমেরিকান সময় অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) ফ্লোরিডার নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ছবি: ফেসবুক থেকে
-
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে জরুরি নম্বরে ফোন করা হয়। দ্রুত চিকিৎসাসেবা এলেও শেষরক্ষা হয়নি। কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন এই কিংবদন্তি কুস্তিগির। বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচারও হয় তার। মাঝেমধ্যে গুজব ছড়ায়, তিনি কোমায় চলে গেছেন। তবে স্ত্রী সেই খবর অস্বীকার করেছিলেন। এর কিছুদিন পরেই এল মৃত্যুসংবাদ।
-
বিশ্ব কুস্তি সংস্থার (ডব্লিউডব্লিউই) পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, ‘হাল্ক হোগান শুধুই একজন কুস্তিগির ছিলেন না, তিনি ছিলেন পপ সংস্কৃতির প্রতীক। ১৯৮০ এর দশকে বিশ্বজুড়ে ডব্লিউডব্লিউই জনপ্রিয় করার পেছনে তার অবদান স্মরণীয়। তার পরিবার, বন্ধু ও অগণিত অনুরাগীর প্রতি আমাদের সহমর্মিতা রইল।’
-
হাল্ক হোগানের প্রকৃত নাম ছিল টেরি জিন বোলিয়া। জন্ম ১৯৫৩ সালের ১১ আগস্ট আমেরিকার জর্জিয়ার অগাস্টা শহরে। বড় হয়েছেন ফ্লোরিডার টাম্পা এলাকায়।
-
তরুণ বয়সে তিনি একজন রক ব্যান্ডের বেজ গিটারিস্ট হিসেবে সংগীতজগতে পা রাখেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে টেনে নেয় কুস্তির রিংয়ে।
-
৬ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী হোগান ১৯৭০ এর দশকে ফ্লোরিডার স্থানীয় কুস্তিগিরদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। দ্রুতই কুস্তি দুনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন।
-
তার বিশাল গড়ন, উদ্দীপ্ত চেহারা আর অনন্য ভঙ্গিমা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। দর্শকদের একাংশ তখন তার সঙ্গে জনপ্রিয় কমিক চরিত্র ‘হাল্ক’ এর মিল খুঁজে পান। সেই থেকেই ‘হাল্ক’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।
-
‘হোগান’ পদবিটি তাকে দেন ভিনসেন্ট জে. ম্যাকমোহন, যিনি পরে ডব্লিউডব্লিউই প্রতিষ্ঠা করেন। ৮০ ও ৯০-এর দশকে হোগান ছিলেন ডব্লিউডব্লিউএফ (বর্তমানে ডব্লিউডব্লিউই)-এর সবচেয়ে আলোচিত তারকা। এক সময় তার জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে, ডব্লিউডব্লিউই-এর প্রতিটি বড় ইভেন্টে তাকেই প্রধান আকর্ষণ হিসেবে রাখা হতো।
-
ছয়বারের ডব্লিউডব্লিউই চ্যাম্পিয়ন হোগান ছিলেন রেসলমেনিয়ার মূল মুখ। প্রথম নয়টি রেসলমেনিয়ার আটটিতেই তিনি ছিলেন মূল আকর্ষণ। তার বিশেষ স্টাইল ছিল ম্যাচ জয়ের পর গেঞ্জি ছিঁড়ে দর্শকদের উৎসাহ দেওয়া। চওড়া গোঁফ, পেশীবহুল দেহ আর অসাধারণ বক্তৃতাভঙ্গি তাকে এনে দিয়েছিল ‘সুপারস্টার’ খেতাব।
-
কেবল কুস্তিতেই নয়, বিনোদনের অন্যান্য শাখাতেও তার পদচারণা ছিল বিস্তৃত।
-
হলিউডের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি। এর মধ্যে ‘সাবারবান কমান্ডো’, ‘মিস্টার ন্যানি’ এবং সবচেয়ে আলোচিত ‘রকি-৩’ উল্লেখযোগ্য। রকি ছবির তৃতীয় কিস্তিতে ‘থান্ডারলিপস’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।
-
২০০৫-২০০৭ সাল পর্যন্ত ‘হোগান নোজ বেস্ট’ নামে একটি রিয়্যালিটি শোয়ে দেখা গিয়েছিল তাকে ও তার পরিবারকে।
-
ক্যারিয়ারের একটি সময় (১৯৯৬) তিনি ডব্লিউডব্লিউই ছেড়ে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নামে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী কুস্তি সংস্থায় যোগ দেন। তবুও ২০০৫ সালে তাকে ডব্লিউডব্লিউই ‘হল অফ ফেম’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
-
তবে তার জীবন কেবল সাফল্যের গল্প নয়, বিতর্কও ছায়ার মতো সঙ্গী হয়েছিল। ২০১৫ সালে একটি গোপন ভিডিও প্রকাশ পেলে ডব্লিউডব্লিউই তার ‘হল অফ ফেম’ সম্মান বাতিল করে। যদিও সেই ভিডিও প্রকাশকারী সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করে জয় পান হোগান। ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে সেই সংস্থা শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া হয়ে যায়। পরে ২০২০ সালে আবার তাকে ‘হল অফ ফেম’ দেওয়া হয়।
-
ব্যক্তিগত জীবনেও হোগান ছিলেন আলোচিত।
-
তিনি জীবনে তিন বার বিয়ে করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা হোগানের বিরুদ্ধে একাধিক বার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ ওঠে।
-
রাজনৈতিকভাবে তিনি যুক্ত ছিলেন রিপাবলিকান শিবিরে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের খোলাখুলি সমর্থক ছিলেন। ট্রাম্পের সমর্থনে বিভিন্ন জনসভায়ও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
-
সব মিলিয়ে হাল্ক হোগান ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র, যার জীবন কুস্তি রিংয়ের মতোই নাটকীয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও উত্তেজনায় ভরপুর। তার মৃত্যু কুস্তি জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।