চুপচাপ এগিয়ে যাওয়া এক ক্রিকেটারের আত্মকথা
তারকাখ্যাতির ঝলক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শোরগোল কিংবা প্রতিটি ইনিংসের পর শিরোনাম হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এসবের কোনোটাই যার ক্রিকেটজীবনের চালিকাশক্তি নয়, তিনি নিতিশ রানা। তার ব্যাটে অনেক সময় ঝড় ওঠে, আবার অনেক সময় নিঃশব্দে ম্যাচের রাশ নিজের হাতে নেন। আলোচনার কেন্দ্রে না থেকেও মাঠে থেকে যাওয়ার এক অদ্ভুত দৃঢ়তা আছে তার মধ্যে। তাই নিতিশ রানার গল্প কোনো এক রাতের সাফল্যের নয়; এটি ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলার, অপেক্ষার ভেতর প্রস্তুত থাকার আর প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগানোর আত্মকথা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে
-
দিল্লির ব্যস্ত ক্রিকেটপাড়ায় বেড়ে ওঠা এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান জানেন, প্রতিভা থাকলেই যথেষ্ট নয়; টিকে থাকতে হয় মানসিক শক্তি দিয়ে। কখনো দলের প্রয়োজনে ওপেনিং, কখনো আবার মিডল অর্ডারের দায়িত্ব; ব্যাটের পাশাপাশি বল হাতে সামান্য হলেও ভারসাম্য আনার চেষ্টা সব মিলিয়ে নিতিশ রানা সেই ক্রিকেটার, যিনি নিজের ভূমিকা নিয়ে কখনো অভিযোগ করেন না। তিনি চুপচাপ এগিয়ে যান, কারণ তার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট নিজেই কথা বলে।
-
১৯৯৩ সালের এই দিনে জন্ম নেওয়া নিতিশ রানার ক্রিকেটজীবনের শুরুটা খুব ব্যতিক্রমী নয়; দিল্লির অজস্র তরুণ ক্রিকেটারের মতোই গলির ক্রিকেট, স্থানীয় টুর্নামেন্ট, তারপর বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ। কিন্তু পার্থক্যটা তৈরি হয় তার মানসিকতায়। ছোটবেলা থেকেই নিতিশ ছিলেন আক্রমণাত্মক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান, যিনি শুধু টিকে থাকার জন্য খেলতেন না, খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চাইতেন।
-
দিল্লির শক্তিশালী ঘরোয়া কাঠামোর ভেতরে জায়গা করে নেওয়া সহজ নয়। তবুও ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের জোরে তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করেন। ব্যাটের পাশাপাশি তার ডানহাতি অফ-ব্রেক বোলিং দলকে বাড়তি ভারসাম্য এনে দেয়, যা আধুনিক ক্রিকেটে অলরাউন্ডার হিসেবে বড় প্লাস পয়েন্ট।
-
নিতিশ রানা নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও, দীর্ঘদিন তাকে ‘ব্যাটিং অলরাউন্ডার’ হিসেবেই দেখা হয়েছে। এর কারণ, তার বোলিং খুব বেশি উইকেট না নিলেও ম্যাচের গতি ভাঙতে কার্যকর। বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মাঝের ওভারগুলোতে তার অফ-ব্রেক প্রতিপক্ষের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
-
তবে নিতিশের আসল শক্তি ব্যাটিংয়ে, বিশেষ করে স্পিন বোলিংয়ের বিরুদ্ধে। লং অন, মিডউইকেট কিংবা কভার দিয়ে খেলতে তার আত্মবিশ্বাস চোখে পড়ার মতো। তিনি এমন একজন ব্যাটসম্যান, যিনি চাপের মধ্যেও স্ট্রাইক রোটেশন জানেন, আবার প্রয়োজন হলে ঝুঁকিও নিতে পারেন।
-
ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক খেলোয়াড়ই আছেন, যাদের জাতীয় পরিচিতি গড়ে ওঠে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ এর মাধ্যমে। নিতিশ রানাও এর ব্যতিক্রম নন। কলকাতা নাইট রাইডার্স দলে যোগ দেওয়ার পর তার ক্যারিয়ারে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
-
কেকেআর দলে নিতিশ শুধু একজন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান নন; তিনি দলের কৌশলগত অংশ। কখন ওপেন করবেন, কখন এক নম্বর ডাউন এই নমনীয়তা তাকে দলের জন্য অমূল্য করে তোলে। কয়েকটি মৌসুমে ধারাবাহিকভাবে বড় রান না পেলেও, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার ইনিংস দলকে ম্যাচে ফিরিয়েছে বহুবার।
-
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লি ক্রিকেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভিজ্ঞ গৌতম গম্ভীর এর জায়গায় দিল্লি দলের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন নিতিশ রানা। এই সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই ছিল চমকপ্রদ। কারণ দিল্লি ক্রিকেট মানেই কঠিন প্রতিযোগিতা, বড় নাম আর উচ্চ প্রত্যাশা।
-
নিতিশের নেতৃত্ব ছিল শান্ত কিন্তু দৃঢ়। তিনি মাঠে চিৎকার করে নেতৃত্ব দেন না, বরং উদাহরণ তৈরি করে দলকে অনুপ্রাণিত করেন। তরুণ ক্রিকেটারদের প্রতি তার আস্থা, সিনিয়রদের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক সব মিলিয়ে তিনি দায়িত্বটাকে দেখেছেন শেখার সুযোগ হিসেবে, ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবে নয়।
-
নিতিশ রানার ক্যারিয়ারে উত্থানের পাশাপাশি কিছু কঠিন সময়ও এসেছে। ফর্মের ওঠানামা, আইপিএলে প্রত্যাশা পূরণ না করার চাপ, জাতীয় দলে নিয়মিত সুযোগ না পাওয়া এসব তার জন্য নতুন নয়। কিন্তু এখানেই নিতিশ অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি নিজেকে বারবার নতুন করে মূল্যায়ন করেছেন। টেকনিক্যাল পরিবর্তন, মানসিক প্রস্তুতি, ফিটনেস সবকিছুতেই তিনি সময় দিয়েছেন। ক্রিকেটে যেখানে অনেকেই দ্রুত হারিয়ে যান, সেখানে নিতিশ টিকে আছেন নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস রেখে।
-
ভারতীয় ক্রিকেটে জায়গা পাওয়া মানে শুধু ভালো খেলাই নয়, বরং সঠিক সময়ে সঠিক ফর্মে থাকা। নিতিশ রানা জাতীয় দলের স্কোয়াডে সুযোগ পেলেও নিয়মিত হওয়ার পথটা সহজ হয়নি। তবে এটাকে ব্যর্থতা না ভেবে তিনি দেখেছেন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, আইপিএলে দায়িত্বশীল ভূমিকা এই দুইয়ের সমন্বয়ই তার লক্ষ্য। কারণ ভারতীয় দলে ফেরার দরজা কখনোই পুরোপুরি বন্ধ থাকে না; বিশেষ করে এমন অলরাউন্ডারদের জন্য, যারা একাধিক ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারেন।
-
নিতিশ রানার গল্পে হয়তো রেকর্ড ভাঙার ঝলক নেই, কিন্তু আছে বাস্তবতা। তিনি সেই ক্রিকেটারদের প্রতিনিধি, যারা প্রতিদিন নিজের জায়গা ধরে রাখার লড়াই করেন। তারকাখ্যাতির বাইরে গিয়ে দলকে কীভাবে অবদান রাখা যায় নিতিশ তার উদাহরণ। তিনি জানেন ক্রিকেট শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের খেলা নয়; এটা দায়িত্বের, ধারাবাহিকতার আর মানসিক শক্তির পরীক্ষা। দিল্লির ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে আইপিএলের আলো-এই পথচলায় নিতিশ রানা প্রমাণ করেছেন, নীরবতাও এক ধরনের শক্তি।