শক্ত হাতে তদারকি করতে পারেননি আতিউর


প্রকাশিত: ০১:৫৮ পিএম, ১৫ মার্চ ২০১৬

টানা আট বছর দায়িত্বে থাকলেও শক্ত ভাবে ব্যাংকিং খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি সদ্য পদত্যাগকারী গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তবে মানবিক গভর্নর হিসেবে বেশ সুমান কুড়িয়েছেন। কিন্তু বিশিষ্টজনরা বলছেন, ব্যাংকিং খাত দেশের অর্থনীতির বড় উপাদান। এখানে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ শক্ত হাতে করতে হবে। গভর্নরের দরজা উন্মুক্ত থাকতে নেই। তাহলে লুটপাট, অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। যেটি গত ৮ বছরে বেশ কয়েকবার সামনে এসেছে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকিং তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক খাত কেটেছে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। ব্যাংক খাতের উপর বিগত ৮ বছরে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক নেতৃত্ব ও গোষ্ঠীগত প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। এসময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনসহ সব ধরনের ব্যাংকের সুশাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে। তৈরি হয়েছে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো আলোচিত ঋণ ঘটনার। বেসিক ব্যাংকের অর্থ লুটের ঘটনাও ঘটেছে তার মেয়াদকালে। বাদ যায়নি বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারির ঘটনাও। আর সবশেষ রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সেটি আরো একবার জোরালোভাবে সামনে এসেছে।

তাদের মতে, ব্যাংকগুলো অধিক মাত্রায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা শক্ত হাতে আটকাতে পারেনি। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থতা, যার দায় কোনভাবেই এড়াতে পারেন না গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করা। তবে বর্তমানে তাতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষি, এসএমই এবং অন্তভুক্তিমূলক অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছে। ফলে জনবল সংকট এবং সার্বিক সক্ষমতায় তদারকিতে এগিয়ে আসতে পারেনি।

তিনি বলেন, সময়ের সাথে নতুন ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনিয়ম এবং দুর্নীতির ধরণ পাল্টেছে। আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সফল হতে পারেনি।

সূত্র মতে, ড. আতিউর রহমানের মেয়াদে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির প্রতারণা, ব্যাংকের পরিচালকের পদ শূন্য হওয়া, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয় টানাপোড়েন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ছিলো সামগ্রিক অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্র। তবে আতিউর রহমানের মেয়াদে সাফল্য এসেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। রিজার্ভ প্রায় কয়েকগুণ বাড়িয়েছেন তিনি।

সূত্র বলছে, বর্তমান সরকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ব্যাংকিং বিভাগ তৈরি করে বিশেষত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সমান্তরাল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে । এসব ব্যাংকের পরিচালনায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতিও গত ৮ বছরে অনেকটাই নাজুক হয়ে পড়েছে।

অপরদিকে, গভর্নরের অনীহার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আর এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিও অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দুটি মূলনীতি হচ্ছে ; স্থিতিশীল মুদ্রানীতি পরিচালনা ও ব্যাংক খাতের ওপর তদারকি-নজরদারির ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান গভর্নরের মেয়াদে এসব ক্ষেত্রে তেমন অর্জন চোখে পড়েনি। এসময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আইন ভেঙে শেয়ারবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত প্রভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কাজে ব্যাংকগুলোকে যথাসময়ে নিবৃত্ত করতে পারেনি, বরং নির্লিপ্ত থেকেছে।

অনেকে অভিযোগ করে বলছেন, মূল দায়িত্বের দিকে খেয়াল ছিলো না গভর্নরের। এসময় তিনি মানবিক ব্যাংক আর অর্ন্তভুক্তিমূলক অর্থনীতির নামে দৌঁড়ঝাপ করেছেন। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর একাধিকবার নানা অনুষ্ঠানে জানান, ‘আমি ব্যাংকিং সেবা অধিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করছি। ব্যাংকিং খাতকে মানবিক করতে চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে ব্যাংকিং খাতের চেহারা পাল্টে গেছে অনেকটা।

২০০৯ সালের মধ্যভাগে এসে ব্যাংকগুলোকে শেয়ারে বিনিয়োগের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েও এসইসি ও ডিএসইর চাপে তা কার্যকর করতে পারেননি তিনি। যা তার ব্যর্থতার পাল্লাকে ভারি করেছে অনেকখানি।

এদিকে নতুন ব্যাংক স্থাপনের সম্পূর্ণ আইনি কর্তৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকলেও সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একমত না হলেও সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়। যার প্রেক্ষিতে ৯টি নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংককে অনুমোদন দিতে হয়েছে। এই সব ব্যাংকের পরিচালনায় মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য বা নেতারা রয়েছেন। এখানে চাপ সামল দিতে পারেননি আতিউর রহমান।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রীর টানাপোড়েন :

হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশ ব্যাংক গর্ভনর ২০১১ সালের ২৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। চিঠিতে তিনি পর্ষদকে দায়ী করেন। একই সঙ্গে আরেকটি চিঠি দিয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডিকে দায়ী করে ৩১ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করতে বলেন। তবে অর্থমন্ত্রী ২৯ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে পারে না।  হলমার্ক কেলেংকারি কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আগে নজরে আসেনি। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি দুর্বলতার কথা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আরো অধিক সংখ্যক মানুষকে ব্যাংকিং সেবার মধ্যে আনতে পেরেছে। ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক হিসাব খোলা, কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) ঋণ বৃদ্ধিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবল উৎসাহ ছিল।

আলোচিত ব্যর্থতার কয়েকটি নজির :

হলমার্কা কেলেঙ্করি : ব্যাংকিং খাতে আলোচিত বিষয় ছিল সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নেয় হলমার্ক গ্রুপ। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় ভুয়া ঋণপত্র বিলের মাধ্যমে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় হলমার্ক।

এ ঘটনার সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তা ছাড়াও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন জড়িত থাকার বিষয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার নামও ওঠে আসে অভিযোগের তালিকায়। দুদক তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে।

আলোচিত এ ঘটনায় বাদ যাননি সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন কবির। এ ঘটনার পর নানা সমস্যার মুখে পড়ে দেশের ব্যাংকিংখাত। ঋণপত্র খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতি সতর্কতার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আছে। শুধু এ ঘটনা নয়, হলমার্কসহ ব্যাংকিং খাতে দুই বছরের ১০ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি বেরিয়ে আসে। নজরদারি দূর্বলতার কারণে এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।

রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের অনিয়ম ও পরিচালক : হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর একে একে জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক এবং বিশেষায়িত আরো কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।

নতুন ব্যাংক : বিদায়ী বছরে আলোচিত ছিল নয় ব্যাংকের অনুমোদন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপসসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ব্যাংকের আবেদন করেন।

এপ্রিলে দেশীয় মালিকানায় ৬টি আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালিকানায় ৩টি মোট ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিশ্ব ব্যাংক এর বিপক্ষে ছিলো। কিন্তু অর্থমন্ত্রী একাধিকার বলেন, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে সরকার তার উদ্দেশ্য সহজেই হাসিল করে নিলো।

ব্যাংকিং খাত : বর্তমান গভর্নরের মেয়াদে তারল্য সংকট ছিলো দৃশ্যমান। বেড়ে যায় ব্যাংকের সুদের হার। ব্যবসায়ী নেতারা পুরো সময়টাই বলতে থাকেন তারল্য সংকটে তারা ঋণ পাচ্ছেন না। তবে শেষ দিকে তৈরি হয় ভিন্ন কথা। অভিযোগ ওঠে সুদ হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

মূল্যস্ফীতি : বিগত ৭ বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে জর্জিত ছিলো সাধারণ মানুষ। উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে চিড়ে চেপ্টা সাধারণ মানুষ। টানা দুই বছর জিনিস পত্রের দাম ছিলো দুই অংকে। তবে তা এখন অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

গভর্নরের দায়িত্ব পালনকালে দেশ-বিদেশে বেশ কয়েকটি পুরস্কার পান আতিউর রহমান। লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী পত্রিকা দি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস তাকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে ‘সেন্ট্রাল ব্যাংকার অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করে। এর আগে ফিলিপিন্সের গুসি শান্তি পুরস্কার পান তিনি। পেয়েছেন সবুজ গভর্নর খেতাব। এছাড়া ইন্দিরা গান্ধী পদকও লাভ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালের ২৮ নভেম্বর, জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন আতিউর রহমান। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি। পিএইচডি ডিগ্রি পান ১৯৮৩ সালে৷

১৯৭৫ সালে মাস্টার্স অধ্যয়নের সময়ই বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে প্ল্যানিং অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আতিউর রহমান। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে (বিআইডিএস)৷ এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।

২০০৮ সালের মে মাসে দেশের ১০ম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান।

এসএ/এসকেডি/এআরএস/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।