উদার অভিবাসন নীতির কারণে স্পেনের অর্থনীতি এখন ইউরোপের রোল মডেল
স্পেনের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি অভিবাসন। যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ সীমান্ত কঠোর করছে, স্পেন তুলনামূলক উন্মুক্ত নীতি গ্রহণ করেছে। ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬ লাখ অভিবাসী দেশটিতে প্রবেশ করছে, যাদের অধিকাংশই কর্মক্ষম বয়সী।
ফলে শ্রমবাজারে কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে, কর্মসংস্থান রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং দক্ষ জনবলের সংকট থেকে রক্ষা পেয়েছে স্পেন। একই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভোক্তা ব্যয়ও বেড়েছে।
নতুন আগতদের একটি বড় অংশ লাতিন আমেরিকা থেকে এসেছে। ২০২৩ সালে স্পেনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রায় ৭০ শতাংশ এসেছে ওই অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসীদের কারণে।
একই ভাষা, সাংস্কৃতিক মিল এবং পূর্ব থেকে থাকা সামাজিক নেটওয়ার্ক তাদের শ্রমবাজারে খাপ খাওয়াতে এবং সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে সহজ করেছে। এই অভিবাসনের ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি স্পেন বৈধ অভিবাসনের নিয়ম সহজ করেছে এবং আরও অনিবন্ধিত অভিবাসীদের কাজ ও বসবাসের অনুমতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
স্পেন ইউরোপের অর্থনীতির দুর্বল অবস্থার মধ্যে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে দেশটির অর্থনীতি গড়ে ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে ইউরোজোনের গড় প্রবৃদ্ধি সামান্য বেশি ১ শতাংশ।
সম্প্রতি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস স্পেনের ক্রেডিট রেটিং বাড়িয়েছে এবং স্পেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৫ সালের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ২.৬ শতাংশে উন্নীত করেছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, স্পেন ইউরোপের দ্রুততম বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি এবং বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী।

এই প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে নানা কারণ। পর্যটন খাত মহামারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেক্সট জেনারেশন ইইউ তহবিল থেকে পাওয়া অনুদান অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করছে সরকার—যার দ্বিতীয় বৃহত্তম সুবিধাভোগী স্পেন। সস্তা নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। তাছাড়া, ২০২১ সালের কর্মসংস্থানের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির মতো সংস্কারও ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
তবে এই অভিবাসন-নির্ভর প্রবৃদ্ধি সতর্কভাবে পরিচালনা করা জরুরি। প্রথমত, ২০১৯ সালের পর থেকে স্পেনের প্রকৃত জিডিপি (ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে) প্রায় ৬.৮ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু মাথাপিছু হিসাবে এ বৃদ্ধি মাত্র ৩.১ শতাংশ। অভিবাসীরা মূলত কম মূল্য সংযোজনকারী খাতে—যেমন হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও নির্মাণ খাতে—কাজ করছে। জীবনমান উন্নত করতে হলে উৎপাদনশীলতার গতি বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পরামর্শ দিয়েছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজির প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য নিয়মকানুন সরলীকরণ ও কর প্রণোদনা প্রয়োজন। দক্ষতা উন্নয়নমূলক উদ্যোগও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে এবং উচ্চমানের পরিষেবা খাতে (যেমন অর্থনীতি, আইটি কনসালটিং, প্রকৌশল) বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করবে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে স্পেনের বেকারত্ব হার এখনো সর্বোচ্চ।
দ্বিতীয়ত, অভিবাসনের উচ্চ প্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী রাখতে হলে সম্ভাব্য সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বেশিরভাগ স্প্যানিশ নাগরিক অভিবাসন সমর্থন করেন, তবে সরকার যদি সাশ্রয়ী আবাসন ও জনসেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই সমর্থন কমে যেতে পারে। অনেকের জন্য ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়ে গেছে এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে আগতদের সঙ্গে স্থানীয়দের মাঝে অশান্তির ঘটনা ঘটেছে।
স্পেনের রাজনৈতিক অস্থিরতাও অগ্রগতির পথে বড় বাধা। প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের নেতৃত্বাধীন কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত সংখ্যালঘু সরকার বড় কোনো আইন পাস করতে হিমশিম খাচ্ছে।
তবুও স্পেন দেখিয়েছে, কীভাবে অভিবাসন অস্থিতিশীল সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উৎস হতে পারে। এই অবস্থান ধরে রাখতে হলে জনসংখ্যাগত সুবিধাকে স্থায়ী সমৃদ্ধিতে রূপান্তরিত করতে হবে।
এমআরএম/এএসএম