যুবশক্তিকে জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্য

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০১:৪৭ পিএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫
রহমান মৃধা

যুবশক্তিকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কীভাবে তরুণদের মধ্যে থাকা অগাধ সম্ভাবনাকে দেশের উন্নয়নের ত্বরান্বিত শক্তিতে পরিণত করা যায়। যুবসমাজ একটি দেশের সবচেয়ে কর্মক্ষম অংশ এবং তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে জাতীয় অগ্রগতি বহুগুণ বেড়ে যায়। আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং পরিবর্তন গ্রহণের ক্ষেত্রে তরুণরাই সবচেয়ে দ্রুত এবং সক্ষম।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্লেষকরা বলছে যে ভবিষ্যতের অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি নির্ভর করবে দক্ষ যুবশক্তির ওপর। বিশ্বে যে খাতগুলো দ্রুত বিস্তার লাভ করছে যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, সবুজ জ্বালানি, ডিজিটাল হেলথ, বায়োটেক এবং ব্লু ইকোনমি, এসব খাত তরুণদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতার উপর দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ যে দেশ তার যুবসমাজকে যত বেশি প্রস্তুত করতে পারবে, সে দেশই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে।

বিশ্বের কয়েকজন শীর্ষ ধনী এবং প্রযুক্তিনেতারা মনে করেন যে তরুণ প্রজন্ম যে কোনো দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। বিল গেটস সবসময় বলে আসছেন যে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো দক্ষ মানুষ। ইলন মাস্ক প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা, প্রকল্পভিত্তিক শেখা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে গুরুত্ব দেন। এই সকল মতামত একটি কথাই প্রমাণ করে যে যুবসমাজকে জনশক্তিতে পরিণত করতে হলে তাদের হাতে অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি এবং সহায়তার সংযোগ তৈরি করতে হবে।

দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বে অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ। অল্প সময়ে তারা যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তার প্রধান কারণ হলো পরিকল্পিতভাবে যুবশক্তিকে দক্ষ করে তোলা এবং শিল্প ও শিক্ষার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা। কোরিয়ার শিক্ষা সংস্কার, ভোকেশনাল ট্রেনিং এবং প্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়ন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মূল্যবান দিকনির্দেশনা।

বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি প্রবণতা লক্ষ্যণীয়, সেটা হচ্ছে সারাক্ষণ অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করা এবং সেই অনুযায়ী রেফারেন্স দিয়ে বর্তমানের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা। একমাত্র বিজ্ঞান ছাড়া এ পর্যন্ত কোনো ধর্ম বা রাজনীতি অতীতের উদাহরণ টেনে শিক্ষা নিয়েছে কী। নিলে হিটলারের পরে নতুন হিটলারের জন্ম হতো না। অতীতের মনিষিদের কথা অতীতেই কার্যকর হয়নি, এখন কীভাবে তা হবে। দরকার হেয়ার অ্যান্ড নাও শক্তি। এটা আমার মতামত।

দেশের যুবশক্তি দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিকদের প্রলোভনে পড়ে তাদের নিজস্ব মেধাশক্তিকে ধ্বংস করছে সঠিক দিকনির্দেশনা এবং কাঠামোগত যত্নের অভাবে। ফলে তারাও এখন দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক দলের সংস্পর্শে থাকতে পছন্দ করে। একটি পরিপক্ব ফল যেমন যত্নের অভাবে পচে যায় তখন তার জায়গা হয় গার্বেজে এবং সেই দুর্গন্ধ ফল সারাক্ষণ গার্বেজে থাকতে পছন্দ করে। প্রশ্ন হলো, যারা এখনও পথভ্রষ্ট হয়নি বা পচেনি, তাদের ঘা মেরে কীভাবে বাঁচানো যাবে?

প্রথমত দরকার একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতি যেখানে গডফাদার সংস্কৃতি, পরিবারতন্ত্র বা দলীয় নিয়ন্ত্রণের অযাচিত হস্তক্ষেপ থাকবে না। দ্বিতীয়ত প্রয়োজন বাস্তবসম্মত এবং ভবিষ্যতমুখী দক্ষতা উন্নয়ন পরিকল্পনা। তৃতীয়ত দরকার ইচ্ছাশক্তি, স্বচ্ছতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি যা জনশক্তিকে সত্যিকার মূল্যায়ন দিতে পারে।

বাংলাদেশে যে বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী আছে, তারা সঠিক মূল্যায়ন এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে। তাদের যদি ফিউচার স্কিল শেখানো যায় এবং বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুত করা যায়, তাহলে তারা দেশের উন্নয়নকে বহুগুণে এগিয়ে নিতে সক্ষম।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের নেতৃত্ব প্রায়ই পারিবারিক বা উত্তরাধিকার ভিত্তিক দলের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা, মতবিরোধের সম্মান এবং নতুন নেতৃত্বের বিকাশের সুযোগ প্রায়শই অনুপস্থিত। এর ফলস্বরূপ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, প্রশাসনিক অনিয়ম এবং রাজনৈতিক প্রলুব্ধতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।

এই পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে ক্ষয় সৃষ্টি করেনি, বরং যুবশক্তির মূল্যায়ন ও সঠিক ব্যবহারে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দেশীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেতৃত্বহীনতা ও নৈতিক দুর্বলতা যুবশক্তিকে তাদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করতে বাধা দিচ্ছে। তবু, এই চক্র ভাঙার সুযোগ এখনো আছে-একটি সাহসী প্রজন্ম, সততা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারলে, উত্তরাধিকারের শৃঙ্খল ভেঙে বাংলাদেশ তার ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবে।

উত্তরাধিকারী ক্ষমতার দীর্ঘায়িত কেন্দ্রীকরণ কেবল দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সৃষ্টি করেনি বরং যুবশক্তিকে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাধা দিয়েছে। অ্যাঞ্জেলা মেরকেল বা মার্গারেট থ্যাচারের মতো আন্তর্জাতিক নেতারা সময়মতো ক্ষমতা হস্তান্তর করে গণতন্ত্রের শক্তি বজায় রেখেছেন, যেখানে বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নতুন নেতৃত্বের বিকাশকে হ্রাস করেছে। দল ও সমাজে ব্যক্তিগত আনুগত্যের সংস্কৃতি নেতৃত্বহীনতা ও নৈতিক দুর্বলতাকে উৎসাহিত করেছে, যার ফলে যুবশক্তি সঠিক প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনার অভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। তবু, পরিবর্তনের আশা হারানো যায়নি। একটি সাহসী প্রজন্ম, সততা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুললে, এই চক্র ভাঙা সম্ভব এবং বাংলাদেশ তার ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবে।

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দক্ষ এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। শ্রম রপ্তানি, দক্ষতার স্বীকৃতি, প্রশিক্ষণ সহযোগিতা, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং বিনিয়োগ বাড়াতে সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক ভূমিকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশের ভেতরে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনিক সংহতি এবং প্রয়োজনে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্বশীল ও আইনসম্মত সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবই হতে হবে সংবিধানসম্মত, স্বচ্ছ এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে।

সঠিক পরিকল্পনায় সততার ভিত্তিতে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি যুবশক্তিকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায় তাহলে তারা হতে পারে অমূল্য সম্পদ। তারা শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, বৈশ্বিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এই বড় জনগোষ্ঠীর হাতেই, আর তাই তাদের মধ্যে বিনিয়োগ করা মানে দেশের ভবিষ্যতের ভিত্তি শক্তিশালী করা।

রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]