প্রবাস ফিরে মাকে দেখতে পাব তো

অসুস্থ মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবা আর ছোট ভাইকে সঙ্গে করে বিমানবন্দর চলে আসলাম। বাবাকে খুব রহস্যজনক মনে হচ্ছিল। এর আগে কখনো এমনটা মনে হয়নি। মা অসুস্থ হবার পর থেকে বাবা আনমনে থাকেন। কারো সাথে তেমন কথা বলেন না। আমিও বুঝতে পারি বাবা লোক চক্ষুর আড়ালে কাঁদেন, কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দেন না।
এতদিনের জীবন সঙ্গীকে এই মুমূর্ষু অবস্থায় দেখে সবারই কষ্ট হবার কথা। বাবা মায়ের সামনে তেমন আসেন না। মায়ের সামনে এলেই নাকি তার বুক ফেটে যায়। মায়ের জন্য কিছু করতে না পারার ব্যর্থতায় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
বাবা, আমি আর ছোট ভাই বিমানবন্দরের বাহিরে বসে আছি। আমাদের কাছাকাছি একজন প্রবাসী যাত্রীকে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
তিন বছর আগে আমার বড় ভাই মিজান সিঙ্গাপুরে যাবার আগেও মা এখানে এসেছিলেন। সেদিন মা ভাইকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তখন মনে হয়েছিল মা হঠাৎ করে শিশু হয়ে গেছেন।
আজ সেই একই জায়গা শুধু ভাইয়ের পরিবর্তে আমি যাচ্ছি প্রবাসে। আর মায়ের জায়গা নেওয়ার মতো পৃথিবীতে কেউ নেই, আর কেউ নিতেও পারবে না। তাই মায়ের জায়গা খালি। আমি শূন্যে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই ছোট ভাই রবিউল পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ভাই আপনাকে শান্ত্বনা দেবার মতো ভাষা আমার জানা নেই। মাকে এই অবস্থায় রেখে যাচ্ছেন যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে এসে দেখবেন। তবে আমার মন বলছে মা সুস্থ হবেন। আমি ছোট ভাইকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
বাবা মোবাইলে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এসে মোবাইলটা আমার দিকে দিয়ে বলল, তোর বোনের সাথে কথা বল। আমি মোবাইলটি কানের সাথে লাগিয়ে বোনের সাথে পারিবারিক আলাপচারিতা করার পর বললাম, ‘আপা মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস।’ আর কিছু বলতে পারলাম না। ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময় আর বেশি নেই এখনই চেক-ইন করে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে।
বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। পেছন থেকে বাবা বললেন, শোন নিজের প্রতি খেয়াল রাখিস। আর তোর মায়ের কিছু হলে আমিও বাঁচব না, মনে কর এটাই তোর বাবার সাথে তোর শেষ দেখা। বাবার কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারিনি। দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। নিজের অজান্তে বাবা ছেলে দু’জনেই কাঁদলাম।
নিজেকে শক্ত করে বুকে পাথর বেধে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। চেক-ইন করে পুলিশ ইমিগ্রেশন পাড়ি দিয়ে অপেক্ষারত রুমে এসে বসলাম। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখ বন্ধ করতেই বউ ফোন দিল। এতক্ষণ আমি নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম আমার প্রিয়তমার কথা। বউ ফোন দিয়ে কিছু বলছে না। ওপাশ থেকে তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছি।
রাত এগারোটায় সিঙ্গাপুর চাংগি বিমানবন্দর এসে পৌঁছালাম। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি, জেট লেগ, শতশত অপরিচিত মুখ। বিমানবন্দরে পা দিয়েই আমি খানিকটা শংকা ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম। বিমানবন্দরের যে জিনিসটা আমার চোখে পড়ল তা হলো শৃঙ্খলা। যে যার মতো করে যাচ্ছে।
আমি আমার লাগেজ নিয়ে একটি লাইনের পেছনে দাঁড়ালাম। একটা একটা করে ট্যাক্সি আসছে আর একজন একজন করে সে ট্যাক্সিতে চড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার সামনের কাউকে চিনতে পারছিলাম না। আমার সাথের সবাই গেল কই? আমার সাথের কাউকে না দেখে আমি দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। আমার কপাল ঘামছে। শিরদাঁড়া বেয়ে কোমল পানির স্রোতধারা বয়ে যাচ্ছে।
একটু দুশ্চিন্তা করার কারণেই আমার রক্ত দ্রুত চলাচল করছে, তাই কপাল ঘামছে। আমার গলায় ঝুলানো নেমপ্লেট আর কোম্পানির নাম দেখে একজন সিকিউরিটি অফিসার এসে বলল, স্যার আপনি কোথায় যাবেন? আমি কিছুটা শংকা আর ভয়ে বললাম, জানি না কোথায় যাব। আমার সাথে আরও ৪৪ জন আছে কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমার নেম প্লেট দেখিয়ে বললাম, আমরা এই কোম্পানিতে এসেছি।
সিকিউরিটি অফিসারটি মধ্যবয়স্ক তিনি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, আসুন আমার সাথে। আপনার সাথের লোকজন অন্য গেটে অবস্থান করছে। আপনার কোম্পানির এইচআর আপনাদের রিসিভ করতে গাড়ি নিয়ে এসেছে। তিনি আমাকে জায়গামতো এনে দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি পেছন থেকে বললাম, থ্যাংক ইউ স্যার। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
আমাকে দেখে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মিন্টু ভাই এগিয়ে এসে বললেন, কোথায় গিয়েছিলে তুমি? সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কিছু বলতে পারলাম না। একজন এইচআর প্রতিনিধি এসে বলল, তাহলে সবাই এখানে। আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, ইয়েস। সে উচ্চস্বরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ওয়েলকাম টু সিঙ্গাপুর। আমরা আবারও সমস্বরে বলে উঠলাম, থ্যাক ইউ।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, সবাই আমার কাছে পাসপোর্ট জমা দিন। আপনাদের কাছে যে আইপি আছে তা সযত্নে রাখবেন। পুলিশ দেখতে চাইলে দেখিয়ে দেবেন। আপনাদের পারমিট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত এই আইপি সাথে রাখতে হবে। পারমিট হয়ে গেলে আইপির দরকার হবে না। আমার কথা কি সবাই বুঝতে পারছেন? সবাই সমস্বরে বললাম, ইয়েস।
এইচআরের কাছে পাসপোর্ট জমা দিয়ে একে একে সবাই লাগেজ নিয়ে বাসে চড়ে বসলাম। আমার পাশে বসেছেন মিন্টু ভাই। তিনি আমাকে বললেন, জানো ওমর আমি এর আগে সিঙ্গাপুরে কাজ করে গিয়েছি। যা ইনকাম করেছিলাম তা খুইয়ে এখন আবার নতুন করে শুরু করতে সিঙ্গাপুর আসলাম। আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছি, বারবার মায়ের মলিন চেহারা, বাবার কান্নারত মুখ, বউয়ের মায়াবী হাসি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করি কিন্তু পারছি না। নিজেকে সংযত করে মিন্টু ভাইকে বললাম, ভাই তাহলে তো আপনি সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অনেককিছু জানেন। আমাকে কিছু বলুন।
মিন্টু ভাই আমার কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে নড়েচড়ে বসে বললেন, সিঙ্গাপুরে জাতীয় সঙ্গীত মালয় ভাষায়। মাজুলা সিঙ্গাপুর বা সিঙ্গাপুর এগিয়ে চল। এখানে চারটি সরকারি ভাষা রয়েছে। ইংরেজি, মান্দারিন, মালয় ও তামিল। তবে অফিসিয়াল ভাষা ইংরেজি। এদেশে নাগরিকরা বেশিরভাগ কথার শেষে `লা’ শব্দটি ব্যবহার করে। যেমন ধর, ‘ওকে’ কে বলেন ‘ওকে -লা’ থ্যাংক ইউ বলার সময় বলেন থ্যাঙ্ক ইউ `লা’। আমি বললাম এই ‘লা’ এর মানে কি? মিন্টু ভাই বললেন, ‘আই ডোন্ট নো লা’ আমি তার মুখে `লা’ শুনে হেসে উঠলাম।
মিন্টু ভাই আবারো বলল, আরো শুনে রাখো কাজে লাগবে, এখানে খাবারকে বলে মাখান, রাস্তায় থুথু ফেললে তোমাকে তিনশ ডলার জরিমানা দিতে হবে। পান খেয়ে পিক ফেললেও জরিমানা দিতে হবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রসাব করলেও জরিমানা দিতে হবে। লুঙ্গি পরে রাস্তায় বের হলে পুলিস এসে চেক করবে অন্তর্বাস আছে কি না? না থাকলে জরিমানা। এই কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। তিনি একটু থেমে আবারো বললেন, ১৯৯২ সালে সিঙ্গাপুরে চুইংগাম নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ চুইংগামে পথচারীদের অসুবিধা হয়।
আত্মহত্যার চেষ্টা করা সিঙ্গাপুরে আইনবিরোধী কাজ। পেনাল কোডের ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে মানুষদের জেল হয় সিঙ্গাপুরে। সমকামিতা এখানে বেআইনি। তবে জুয়া আইনসিদ্ধ। অনুমতি না নিয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। নিজের ঘড়ের মধ্যে নগ্ন থাকলেও আইনত শাস্তি হতে পারে সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের। কারণ আইন অনুযায়ী নগ্ন অবস্থায় কেউ দেখে ফেললেই যিনি নগ্ন ছিলেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যাবে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এত জরিমানা লোকজন দেয় নাকি পুলিশিকে ঘুষ দিয়ে পার পেয়ে যায়।
মিন্টু ভাই আমার কথা শুনে হেসে দিলেন। কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই আমাদের গাড়ি এসে একটি গেটে থামল। আমি মিন্টু ভাইকে ধন্যবাদ দিলাম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানানোর জন্য। বাস থেকে নেমে তাকিয়ে দেখি বিশাল বড় বাড়ি। গাঁ ঘেঁষা তিনটি দালান। এটা আবার কেমন বাড়ি বুঝতে পারলাম না। আমার কাছে বাড়ি মানে অপরিচিত কেউ গেটে আসলেই কুকুরের ঘেউ-ঘেউ শব্দ, বাড়ির সামনে ছোট ফুলের বাগান কিন্তু এ দেখি অন্যকিছু। চারপাশে বিশাল দেয়াল, সিসি ক্যামেরা।
গেটের সামনে তিনজন সিকিউরিটি বসে আছেন। একজনের সুদর্শন কালো গোফ, মাথায় টাক তার চোখ দুটি লালচে দেখে মনে হচ্ছে নেশাজাতীয় কিছু খেয়েছেন। তিনি একটি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে উদাস দৃষ্টিতে সিগারেট টানছেন। বয়স আনুমানিক চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হবে। তার পাশের দু’জনকে দেখে তাদের জন্য মায়া অনুভব করলাম। তাদের বয়স ষাট বছরের ঊর্ধ্বে। বয়সের ভারে তারা ন্যুজ। বসে বসে তারা ঝিমুচ্ছেন। আমাদের দেশে এই বয়সের লোকজন কর্ম জীবন থেকে ইস্তফা দিয়ে ধর্মকর্মে মনোযোগী হন।
মিন্টু ভাই আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন, কি দেখছ এত মনোযোগ দিয়ে?
না কিছু না।
এটাই আমাদের ডরমিটরি, আমরা এখানেই থাকব। এখানে যারা থাকেন তারা সবাই আমাদের মতো প্রবাসী। এই বাড়ির চারপাশ খুবই সুরক্ষিত কেউ এই গেট ছাড়া বের হতে পারবে না।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। সিঙ্গাপুর এসে আমার বিস্ময় বেড়েই চলছে।
ওমর ফারুকী শিপন/সিঙ্গাপুর থেকে/এমআরএম/এমএস