ছেলেটি সবার চোখ খুলে দিয়েছে

ওমর ফারুকী শিপন
ওমর ফারুকী শিপন ওমর ফারুকী শিপন , সিঙ্গাপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১১:৫৫ এএম, ২১ নভেম্বর ২০১৯

রুমে শ্বাসরুদ্ধকর বৈঠক চলছে। একজনের বিচার করা হবে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে অন্যজনের এক প্যাকেট তরকারি চুরি করে খেয়েছে। আর এই বিচার কাজ হচ্ছে রুম লিডারের নেতৃত্বে। আমি এক কোণায় বসে আছি, আমার মাথায় অতীতের সব ঘটনার দিবালোকের মতো একে একে ভেসে উঠছে। আমি অতীতে হারিয়ে গেলাম।

যখন আমরা সিঙ্গাপুর আসি। তখন প্রতিরুমে ১৬ জন করে সদস্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এই ১৬ জন সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একজন রুম লিডার নিয়োগের কথা এইচআর থেকে বলা হলে, কেউই রুম লিডার হতে রাজি হলো না। আমরা এক প্রকার জোর করেই একজনকে রুম লিডার নিয়োগ দিয়েছিলাম।

বিজ্ঞাপন

দুই তিন মাস পর যখন শুনলাম রুম লিডার তার দায়িত্ব পালনের জন্য কোম্পানি থেকে মাসিক ৫০ ডলার সম্মানি পান এবং কোম্পানির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক কিংবা ডিনার করার সুযোগ পান। তখনই রুম লিডার হবার জন্য কয়েকজন উঠেপড়ে লেগে গেল। তখন তারা রুম লিডারের বিপক্ষে বিভিন্ন কুৎসা রটাতে শুরু করল।

রুম লিডার অলস, বেশি খায়, সারাদিন ঘুমায়, আরও নানা অভিযোগ। আসলে যাকে ভালো লাগে না, তার মিষ্টি হাসিও আমাদের কাছে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মনে হয়। তখন মনে হয় এই হাসির মতো নিকৃষ্টতম জিনিস বুঝি পৃথিবীতে আর নাই।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যেহেতু কয়েকজন রুম লিডার হতে চায় সেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রুমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে। নির্বাচিত ব্যক্তিই হবে রুম লিডার। রুম লিডার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রুমে উৎসবমুখর পরিবেশে পরিণত হয়েছিল। প্রায়ই নিবার্চনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা পোলাও, কোর্মা রান্না করে খাওয়াতে লাগল। আমাদের কদর বেড়ে গেল। মাঝে মাঝে আমার রান্নাও তারা করে দিত।

সুষ্ঠু নির্বাচন হলো। একজনকে রুম লিডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। তার বিরোধীরা অভিযোগ করল নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তারা পুন:ভোট গ্রহণের অনুরোধ করলেন। কিন্তু আমরা তাদের গুরুত্ব দিলাম না। আমরা নিয়ম করলাম প্রতি বছর রুম লিডার নির্বাচন হবে। কিন্তু রুম লিডার তার দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সুষ্ঠুভাবে রুম পরিচালনা করায় আর নির্বাচন করার প্রয়োজন হয়নি। সে এককভাবে রুম পরিচালনা করছে।

কয়েকমাস আগে একজন রুমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। সে প্রায় অশ্লীল কথাবার্তা বলতেন রুম লিডার তাকে কয়েকবার সতর্ক করলেন তবুও সে শুধরালেন না। বাধ্য হয়ে রুম লিডার তার বিরুদ্ধে ডরমিটরি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন। সিকিউরিটি তাকে সতর্ক করে অন্য রুমে বদলি করে দেয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কিছুদিন আগে এক রুমমেটের আড়াইশ ডলার রুম থেকে চুরি হয়। সে তখন বিভিন্ন লোককে সন্দেহ করতে থাকে। মানুষের কিছু হারিয়ে গেলে তার মন দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন কোনো যুক্তিই তার মাথায় কাজ করে না। তখন আশপাশের সবাইকে চোর মনে হয়। যেদিকে তাকায় সেদিকেই দেখে চোর আর চোর। রুমমেটের কাছে উপযুক্ত প্রমাণাদি না থাকায় সে পুলিশ কিংবা সিকিউরিটির কাছে অভিযোগ করতে পারেনি। রুম লিডার তার দক্ষতা বলে রুমমেটের হারানো টাকা উদ্ধার করে দেন।

রুম লিডার ছোট বড় যে কোনো অপরাধকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। তাই আজ তরকারি চুরির অভিযোগে এখানে সালিশি বৈঠকে বসতে হয়েছে। তার ভাষ্যমতে, ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে একদিন সে বড় অপরাধী হয়ে উঠবে। তাই কোনো ছাড় নয়।

রুম লিডার এখন সবার হাতে হাতে ফল আর একটি করে কোল্ড ড্রিংকস দিচ্ছেন আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে নিলাম। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে এক কোণায় মাথা নিচু করে বসে আছে। বুঝতে পারছি সে লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা আসলেই লজ্জার।

বিজ্ঞাপন

যাকে কেন্দ্র করে বিচার হচ্ছে তাকে কিছুই বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। রুম লিডার তাকে উপদেশমূলক কথা বলতেই সে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে গেল।

কয়েকমাস পর,
রুম লিডারের সাথে রুমের সিনিয়র সদস্যদের শ্বাসরুদ্ধকর মিটিং হচ্ছে। সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। কেউ কিছু বলছে না মিটিং রুমে পিনপতন নীরবতা।

লিডার অভিযোগপত্রটা আবারও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন কার কার অভিযোগ এবং কার বিরুদ্ধে। কিন্তু অভিযোগগুলোতে কারও নাম উল্লেখ নেই।অভিযোগগুলো হলো : রুমের একজনের তীব্র নাসিকা গর্জনে অন্যদের ঘুমের সমস্যা হয়।
-একজন রাতে রুমে জোরে জোরে কথা বলে।
-একজন ঘুমালে তার পরণে পোশাক থাকে না।
-একজন ব্যবহৃত জুতা রুমে নিয়ে আসে।
-একজনের প্রায় ভাত হারিয়ে যায়।
-একজন খুব ভোরে গোসল করে।
-রুমে হাফ প্যান্ট পরে ঘোরে।
-একজনের মোবাইল অ্যালার্মের জন্য রুমের অন্যদের ঘুম ভেঙ্গে যায় অথচ যে অ্যালার্ম দেয় তার নিজের ঘুম ভাঙ্গে না।
-গতকাল একজনের ভাতের প্যাকেট চুরি হয়েছে৷

বিজ্ঞাপন

লিডার অভিযোগত্রটি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। কিন্তু তার হাসলে চলবে না রুমের সবাই তাকে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত করেছে এবং লিডারের দায়িত্ব পালন করার জন্য মাসিক ভিত্তিতে কোম্পানি থেকে তাকে সম্মানি দেওয়া হয়। তার কাজ হলো রুমের সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা। সে ব্যর্থ হলে সমস্যাটি হস্তান্তর করা হয় সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে আর সিকিউরিটি ব্যর্থ হলে তা কোম্পানির এইচআর ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়।

আজ পর্যন্ত রুমের সব সমস্যা লিডার আর রুমের সিনিয়র সদস্যরাই সমাধান করেছে কিন্তু আজকের সমস্যাগুলো তাদের খুব জটিল মনে হচ্ছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান বুঝি তাদের কাছে নেই। লিডার হাসছে আর মনে মনে ভাবছে এগুলো কি কোনো অভিযোগ হলো? এমন সময় ভেড়ানো দরজা ঠেলে রুমের সবচেয়ে জুনিয়র সদস্য ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে প্রবেশ করল। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে সে ঝালমুড়ি লিডারের সামনে রেখে বলল ‘ব্রো আমি কি কিছু বলতে পারি?

একজন সিনিয়র সদস্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘লিডার এই বাচ্চা ছেলেকে এখানে প্রবেশ করার অনুমতি কে দিয়েছে?’

বিজ্ঞাপন

-আমিই বলেছিলাম সবার জন্য ঝালমুড়ি নিয়ে আসতে। লিডার ঝালমুড়ি হাতে নিতে নিতে জবাব দিলো।

লিডার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল এখন কি করা যায়, আপনারাই বলুন। এভাবে চুপ করে বসে থাকলে তো আমরা সমাধানে আসতে পারব না। আর এখানে যে অভিযোগ জমা হয়েছে, আমি গোপনে তদন্ত করে দেখেছি সবগুলোই সত্য। এখন এই অভিযোগগুলোর সমাধান কীভাবে করা যায় আপনারাই বলুন। কেউ কিছু না বলে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ী করছে। রুমের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য বলল ‘লিডার আপনিই রায় বলুন, আপনি আমাদের লিডার যা বলবেন তাই সবাই মেনে নেব।’

আমি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। লিডার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘আচ্ছা, আমি রায় দেওয়ার আগে রুমের জুনিয়র সদস্য কি বলতে চায় শুনে নেই, কি বলেন আপনারা? ‘সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল।’

বিজ্ঞাপন

জুনিয়র সদস্যটি লিডারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল ‘আমরা যদি কাউকে অপছন্দ করি তাহলে তার ছায়া দেখলেও মেজাজ গরম হয়ে যায়। তখন তার কোনো কিছুই আমাদের ভালো লাগে না যদিও সে গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।’

সো আমাদের রুমে আমরা হয়ত একে অপরকে পছন্দ করি না তাই একে অপরের কিছুই ভালো লাগে না। এখন এই সমস্যা সমাধানের একটিই উপায় যার এগুলো ভালো লাগে না সে যেন এই রুম ছেড়ে চলে যায়। যেখানে মানুষ বাস করে সেখানে এই টুকিটাকি সমস্যা হবেই। এগুলো মেনে নিয়েই আমাদের থাকতে হবে। কেউ কোনো বেয়াদবি নেবেন না, এটা আমার রায় না শুধু প্রস্তাব।

তার কথা শুনে আমি আনন্দিত হলাম। ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে ডেকে পুরস্কৃত করি। মেধাবীদের কোনো বয়স নেই, ছেলেটি সেটাই প্রমাণ করল।
সবাই নবীন সদস্যটির মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। লিডার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল ও যা বলেছে সঠিক বলেছে, আজ থেকে নাসিকা গর্জন, মোবাইলে অ্যালার্ম, আর লুঙ্গি খুলে গেলেও কোনো সমস্যা নাই যদি কেউ এগুলোকে সমস্যা মনে করে সে যেন রুম ছেড়ে চলে যায়।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

সবাইকে কিছু না বলে নীরবে যে যার যার বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপতে লাগলাম। আজকে রুমের জুনিয়র ছেলেটি সবার চোখ খুলে দিয়েছে।

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com