বাবার মৃত্যুতে মা কাঁদেনি, আমি কেঁদেছি

বাড়ি থেকে কল দিয়ে মা বললেন, উনি মারা গেছেন। আমার বুঝতে বাকি রইল না মা উনি বলতে কাকে বুঝিয়েছেন। তারপরও বললাম, মা কী বলছ বুঝলাম না। মোবাইলের ওপাশে নীরবতা নেমে এলো। মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। মা নিজেকে ঠিক করে আস্তে বললেন, তোর বাবা আর নেই। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
বাবার মৃত্যুর সংবাদে আমি কেঁপে উঠলাম। মনে হচ্ছে শূন্যে ভেসে যাচ্ছি। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। আমার অবলম্বন বলতে কিছুই নেই। আমি একা বড়ই একা। বাবার মৃত্যুতে আর কেউ খুশি হোক আর না হোক মায়ের তো খুশি হওয়ার কথা। আমি কেঁদেছি, কিন্তু মা কাঁদেনি। না কাঁদার অনেক কারণও ছিল মায়ের।
আমার বয়স যখন দুই বছর তখন মা বাবার সাথে ঝগড়া করে নানার বাড়ি চলে আসেন। মা বাবার সাথে সংসার করতে অনীহা প্রকাশ করেন। শুনেছি এর কিছুদিন পর বাবা লোকজন নিয়ে নানার বাড়ি হাজির হন। তার দাবি মা যেতে না চাইলে সমস্যা নেই কিন্তু তার সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। বাবা মুখে সন্তান নেয়ার কথা শুনে মা নাকি আমাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। মায়ের চোখে অশ্রু দেখে বাবার একটুও মায়া হয়নি। সে জোর করে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
তখন আমার মামারা ও আশপাশের লোকজন তাদের বাধা দিয়েছিল। দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছিল। সেদিন সংঘর্ষে দুই মামা ও নানা আহত হয়েছিলেন। বাবাও রক্তাক্ত হয়েছিলেন। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বাবা আমাকে ফিরে পেতে আইনের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আদালত রায় দিয়েছিলেন, আমার বয়স ৫ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মায়ের কাছেই থাকব। পাঁচ বছর পর বাবা আমাকে নিয়ে যাবেন। কিছুদিন পর বাবা অন্যত্র বিয়ে করে ফেলেন। নতুন বউ বাবাকে একটি পুত্র সন্তান দেয়। সে তার পুত্র সন্তান পেয়ে আমার কথা ভুলে যান। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
আমি বড় হতে থাকি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাবার অভাব অনুভব করি। প্রায়ই মাকে প্রশ্ন করতাম, মা বাবা কই? তুমি বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছো কেন? মা কোনো জবাব দিতেন না। আমার প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে চলতেন। একদিন বাবার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেই। সেদিন নানা আমাকে বাবার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আমাদের সম্পর্কে মজবুত সেতু তৈরি করেন। তিনি মায়ের জন্য আফসোস করেন। মাকে আবারো তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু মা কিছুতেই তার কাছে ফিরে যেতে রাজি নন।
ভাবতে ভাবতে অফিসের বাহিরে এসে দাঁড়াই। বাবার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর চারপাশ ঝাঁপসা হয়ে এলো। মনে হচ্ছে আমি পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, ক্রমশ বহুদূরে। কেউ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি।
সিঙ্গাপুরের কোম্পানির বাস আমাকে রেখেই চলে গেছে। গাড়ির ড্রাইভার সময়মতো গাড়ি ছেড়ে দেন। কেউ এলো আর কে এলো না তাতে তার দেখার সময় নেই। সে রোবটের মতো গাড়ি নিয়ে আসে আর যাত্রী নিয়ে চলে যায়। মাঝেমধ্যে তাকে দেখে রোবট মনে হয় আমার। তাকে কেউ প্রোগ্রামিং করে ছেড়ে দিয়েছে।
আশ্চর্য গাড়ি না পেয়ে আমার আক্ষেপ হলো না। আমি হেঁটেই এগিয়ে চলেছি বাসার দিকে। ইচ্ছে করছে আজ হেঁটেই চলে যাব। বিক্ষিপ্ত চিন্তায় মস্তিষ্ক ক্ষত-বিক্ষত আমার। আমি উদ্দেশ্যহীন হাঁটছি। হঠাৎ আমার গা ঘেঁষে একটি লরি ব্রেক কষাতে আমি জাগতিক জগতে ফিরে আসি। লরির সামনে থেকে একজন পরিচিত লোক বললেন, ভাই আপনার গাড়ি আসেনি?
বললাম গাড়ি এসে সময়মতো চলে গেছে। আমাদের গাড়ি কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ভাই বললেন, লরির পেছনে জায়গা আছে। আপনি উঠে বসুন। আমরা আপনার ডরমিটরির সামনে নামিয়ে দেব।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও লরির পেছনে উঠে বসলাম। সেখানে কয়েকজন লোক বসে আছে। আমি কখনো লরিতে চড়িনি, এটাই প্রথম অভিজ্ঞতা। আনমনে বসে নানা জিনিস নিয়ে ভাবছি। আমি বুঝতে পেরেছি বাবার মৃত্যু সংবাদ দেবার সময় তিনি কাঁদলেন না কেন? নাকি শব্দ না করে তিনি কাঁদছেন। কিছুই বুঝতে পারিনি। বাবা আর মায়ের সম্পর্কের ব্রিজ তো অনেক আগেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। নাকি ব্রিজ ভাঙ্গার পরও অবশিষ্ট ছিল যা আঁকড়ে এতদিন মা বেঁচেছিল। আজ সেই সেটাও নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে। তাই মা সহ্য করতে পারেননি।
শুনেছি একজন জীবিত মানুষের তুলনায় একজন মৃত্যু মানুষের মূল্য আমাদের কাছে বেশি। তাই হয়ত মূল্যহীন বাবা আমার আর মায়ের কাছে অতি মূল্যবান হয়ে উঠেছে। আচ্ছা কারও কাছে মূল্যবান হতে হলে কি আমাকেও মরতে হবে।
আমি মাঝেমধ্যে বাবার কাছে যেতাম। অনেক সময় মাকে না জানিয়ে যেতাম। তবুও মা টের পেয়ে যেতেন। বাসায় ফিরলে বলতেন, বাবার কাছ থেকে কি খেয়ে এলে? মায়ের প্রশ্নে আমি থতমত হয়ে তাকিয়ে থাকতাম কিছু বলতাম না। মা বলতেন ছেলে বাবার কাছে যাবে তাকে আটকে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। আমি জানি আমার সব পরিশ্রম ত্যাগ বৃথা। রক্তের টানে তুমি বাবার কাছে যাবেই, তাই আমি তোমাকে বাধা দেব না।
হঠাৎ লরি ব্রেক কষাতে চিন্তার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। লরি সামনে থামতেই আরও কিছু লোক হুড়াহুড়ি করে চড়ে বসল। সবার গায়ে কাজের পোশাক। গরমের ঘামে ভিজে জবুথবু। ঘামের উদ্ভট গন্ধ পাচ্ছি। যে গন্ধ অন্যান্য সময় বমি আসার কথা। কিন্তু আজ কেন জানি তাদের ঘামের গন্ধ খুব ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে তাদের ঘামে ভেজা পোশাকে নাক ঘষে গন্ধটা নেই। তাদের জড়িয়ে ধরে একটু কান্না করি।
এমআরএম/জেআইএম