ভেবেছিলাম বিদেশে মাহফুজাকে ভুলে যাব

জাহাঙ্গীর সবসময় হাসিখুশি থাকেন। যখনই তার সাথে দেখা হয় তখনই কুশলাদি করে খোঁজখবর নেন। তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তিনিই পৃথিবীর সেরা সুখী। কিছুদিন যাবত তিনি আমাকে দেখলেই বলেন, ভাই আপনার সাথে কথা আছে।
আমিও হাসিমুখে বলি, আচ্ছা বলুন কী কথা।
আমার কথা বলতে অনেক সময় লাগবে। আপনি ফ্রি হলে কল দিয়েন।
তাকে আশ্বস্ত করে বিদায় করে দেই। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় তার কথা বেমালুম ভুলে যাই। গতকাল একাকী বসে মোবাইলে গান শুনছিলাম। সে আমার সামনে এসে বলল, ভাই আপনার সাথে কথা আছে।
আমি গান অফ করে তার দিকে তাকিয়ে আন্তরিকভাবে বললাম, কী কথা বলুন। আজ আমি ফ্রি আছি।
তিনি আমার পাশে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভাই আমার গল্পটা অনেক বড়। আপনাকে ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।
ঠিক আছে ধৈর্য ধরেই শুনব। আপনি বলতে থাকুন।
জাহাঙ্গীর ভাই সিগারেট ধরিয়ে বলতে শুরু করলেন, সেদিন রাতে দু:স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় আমার। স্বপ্নে দেখি আমি মাহফুজার গা ঘেঁষে বসে আছি। সে আরামদায়ক আলস্যে আমার একটি হাত জড়িয়ে ধরে বাদাম খাচ্ছে। সামনে উত্তাল নদীর ঢেউ। সে আমাকে আদুরে গলায় বলছে দেখ কত সুন্দর ঢেউ। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে সমুদ্রের বিশালতা দেখছি। এই নদীর বুকেই কিছুদিন আগে ট্রলার ডুবিতে ১২ জন লোকের অকাল মৃত্যু হয়েছিল।
আমি মাহফুজার কথায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি যে জিনিস যত সুন্দর সে জিনিস তত ভয়ংকর। সুন্দর জিনিস দূর থেকে দেখতে হয়। মাহফুজা উঠে দাঁড়িয়ে আহ্লাদিত হয়ে বলল, চলো নদীর পানিতে সাঁতার কাটি। আমি বারণ করে বললাম, তুমি কি পাগল হয়েছ? এই সময় নদীর পানিতে ভিজলে বাড়ি যাবে কীভাবে? ভেজা কাপড়ে দেখলে বাড়ির সবাই তোমাকে কি বলবে আর রাস্তাঘাটের লোকজনও হাসাহাসি করবে।
‘আমি কারো ধারধারি না। তুমি এলে এসো নইলে আমি একাই নদীর পানিতে সাঁতার কাটব’। আমার কথা তোয়াক্কা না করে সে হাঁটতে শুরু করল। আমি পেছন থেকে তাকে ডেকে নিষেধ করছি কিন্তু সে আমার কোনো কথা শুনছে না। ধীরে ধীরে নদীর পানিতে নেমে গেল। আমি দৌড়ে তাকে বাধা দিতে গেলাম। তার কাছে পৌঁছানোর আগেই ঘুম ভেঙে গেল।
তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তিনটা।
মধ্যরাত! চারপাশে শুনশান নীরবতা। আমার পাশাপাশি কর্মক্লান্ত লোকগুলোর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্যকোনো শব্দ কানে আসছে না। এই দূর পরবাসের জীবন একাকী বড়ই একাকী।
মনে হচ্ছিল আমার সামনে মাহফুজা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে শাড়ি। কি সুন্দর লাগছিল তাকে। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আশপাশ কেউ নেই। সবই আমার ভ্রম। তবে তার ব্যবহৃত পারফিউমের গন্ধ তখনো নাকে লেগেছিল। মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণ আগেও মাহফুজা এখানে ছিল। সে কোনো জরুরি কাজে বাহিরে গেছে। একটু পর আবার ফিরে আসবে।
জাহাঙ্গীর ভাই আর কিছু বলছেন না। আমি প্রশ্ন করলাম এরপর কি হল? আর মাহফুজা কে? তিনি আমার দিকে একটা ডায়েরি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এরপর কি হলো? ডায়েরিটা আমাকে দিয়ে বললেন পড়লেও বুঝতে পারবেন। তার হাতে ডায়েরি দেখে বুঝতে পারলাম সে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই আমার সাথে গল্প করতে এসেছে। আমি হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা নিতেই তিনি বললেন, শোনেন পুরো ডায়েরিটা আপনাকে একবারে পড়তে হবে তাহলে গল্পটা বুঝবেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বিদায় করে দেই।
ডায়েরিটা পড়ার জন্য নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসলাম। আজ আমার কাজ নেই। অফিস থেকে দুইদিনের ছুটি পেয়েছি। যাক অবসর সময় তার ডায়েরিটা পড়ে পার করা যাবে।
গভীর মনোযোগ দিয়ে ডায়েরিটা পড়তে আরম্ভ করলাম, প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা প্রায়ই আমার গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। ভেবেছিলাম প্রবাসে এলে মাহফুজাকে ভুলে যাব। কিন্তু আজও ভুলতে পারছি না তাকে। একাকী জীবনে তাকে বেশি মনে পড়ছে। আমার সমস্ত সুখ সে কেড়ে নিয়েছে। মনে হয় এখনো আমার পাশেই আছে। গত আট বছর যাবত তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। আশ্চর্য এই আট বছরে একদিনের জন্যও তাকে ভুলতে পারিনি। কিন্তু সবার সামনে ভুলে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি।
আমার ধৈর্য শক্তি খুবই কম। তাই আর না পড়ে পরের পৃষ্ঠায় মূল কাহিনিতে চলে গেলাম।
তখন আমি সবেমাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা শেষে গ্রামে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকতাম। সন্ধ্যার পর দলবেঁধে বিভিন্ন ফলফলাদি চুরি করে সবাই মিলে উৎসব করে খেতাম। মনে হত চুরি করে ফল খাওয়ার মতো আনন্দ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। একদিন সবাই মিলে গ্রামের এক গৃহস্তের বাড়ি থেকে মুরগি চুরি করে পিকনিক করি।
পরেরদিন গ্রামে আমাদের নামে বিশাল সালিশ বসে। আমার বাবা ছিলেন হাজী সাহেব। তাছাড়া গ্রামের বিচার তিনিই করতেন। সেদিন গ্রাম্য সালিশে বাবা ছেলের বিচার করতে উপস্থিত হলেন। ভারাক্রান্ত মনে তিনি চেয়ারে বসলেন। তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কিছু দুষ্টু লোক বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
বিচারে আমাদের সবাইকে আর্থিক জরিমানা ও সবার কাছে ক্ষমা চাইতে হলো। বাসায় ফিরে বাবা উত্তেজিত হয়ে মাকে গালাগালি করতে থাকেন। বাবা কখনো সরাসরি আমাকে কিছু বলতেন না। তিনি আমার উপরের রাগ সব মায়ের উপর ফেলতেন। মা বাবার গালাগালি হজম করে আমার পক্ষেই কথা বলতেন।
আমরা তিন ভাই দুই বোন। বড় দুই ভাই প্রবাসে থাকেন আর দুই বোন বিবাহিত। আমি সবার ছোট ছেলে তাই বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন গ্রামেই তাদের কাছে থেকে পড়ালেখা শেষ করি। কিন্তু আমার স্বভাবের কারণে তারা আমাকে দূরে পাঠাতে সিদ্ধান্ত নেন।
বাবা আমাকে ডেকে বললেন, তোমার নামে একগাদা অভিযোগ জমা হইছে। এখন বলো কী করব?
আমি মাথা নিচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাবাকে তখন খুব ভয় পেতাম। সহজে বাবার সামনে পড়তে চাইতাম না। সামনে পড়লে অন্যদিকে চলে যেতাম। আমি জানি বাবা আজ কঠিন কথা বলবেন। এমনকি আমাকে মারধরও করতে পারেন। বাবার হাতের মাইর থেকে রক্ষা পেতে আচমকা বললাম, বাবা আমি শহরে গিয়ে পড়ালেখা করব।
আমার কথা শুনে বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেটাই ভালো হয়। আগামী সপ্তাহে তোমার রেজাল্ট দেবে। রেজাল্টের পর তুমি শহরের কলেজে গিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হও।
আমরা চার বন্ধু মিলে ময়মনসিংহ শহরে একটা রুম ভাড়া করলাম। রুম ভাড়া ১২শ টাকা। জনপ্রতি তিনশ টাকা। আর খাবার খরচ এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাগবে। তাই বাবাকে বললাম, আমাকে মাসে দুই হাজার টাকা দিলেই হবে। বাবা রাজি হলেন।
কিন্তু রেজাল্ট প্রকাশ হবার পর জানা গেল আমার তিন বন্ধুই ফেল। আমি একা পাশ করেছি। ওদিকে বাড়িওয়ালার সাথে কথা দিয়েছি তাদের বাসায় উঠব। ওরা যেহেতু পাশ করেনি তাই ওদের শহরে যাবার প্রশ্নই উঠে না। আমি একাই শহরে রওনা দেই।
নতুন বাসায় একাকী উঠে বিপাকে পড়ে গেলাম। আমার আশপাশে প্রতিটি রুমে চার থেকে ৫ জন করে থাকে আর আমি একা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রুম ভাড়া। চারজনের ভাড়া আমাকে একাই দিতে হবে। খাবারের ব্যবস্থা পাশের রুমের ভাইদের সাথে মেছে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়।
আমার একার পক্ষে বারশ টাকা রুম ভাড়া দিয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না। তাই রুমমেট খুঁজতে লাগলাম। রুমমেট না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম এক মাস পর রুম ছেড়ে দেব। যদি পারি কারো সাথে মেছে থাকব নইলে আপাতত গ্রামে চলে যাব।
মাস শেষে বাড়িওয়ালাকে বললাম, আমি আর থাকব না। সাথে সাথে বাড়িওয়ালা আমাকে ডেকে নিলেন। আমার সামনে বাড়িওয়ালা ও তার স্ত্রী বসে আছেন। আমি মাথানত করে তাদের প্রশ্নের অপেক্ষা করছি। বাড়িওয়ালা নীরবতা ভেঙে বললেন, শুনলাম তুমি নাকি চলে যাবে?
আমি সংক্ষিপ্তভাবে বললাম হ্যাঁ।
কি সমস্যা?
কথা ছিল আমরা চারজন মিলে রুমে থাকব। কিন্তু ওরা কেউ আসেনি। তাই আমার একার পক্ষে রুম ভাড়া বহন করা সম্ভব হচ্ছে না৷
আমার কথা শেষ হতে না হতে পাশের রুম থেকে একজন তরুণী হুহু করে হেসে উঠল। হাসার কারণ আমি তোতলা। কথা বলতে গেলে কথা আটকে যায়। তোতলামো আমার জন্মগত। কেউ যদি আমার তোতলামো দেখে হাসে তখন আমার কষ্টের সীমা থাকে না। তার হাসি আমাকে মনটা ভার করে দিলো। কিন্তু এই বাড়িতে তরুনী মেয়ের হাসি বুঝতে পারলাম না। এখানে একমাস যাবত আছি কোনো তরুণী মেয়ে দেখিনি। আমি জানি বাড়িওয়ালা তার স্ত্রী ও দুই ছেলে আছে বড় ছেলের সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। ছোট ছেলেও মাঝেমাঝে আমার সাথে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়।
আমার কথা শুনে বাড়িওয়ালা তার স্ত্রীর সাথে আলাপ করছে। আমি তাদের আলাপ শুনতে পাচ্ছি। শোন ছেলেটা খুবই ভালো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। সবসময় মাথা নিচু করে চলাফেরা করে। তাই আমি চাচ্ছি সে থাকুক। যদি কোনো ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া পাই তার রুমে থাকতে বলব। নইলে সে একাই থাকুক। এমন ভদ্র ছেলে বাড়িতে থাকা মানে লক্ষী।
তারা সিদ্ধান্ত নিলো আমি মাসে তিনশ টাকা ভাড়া দিয়েই এখানে থাকব। তাদের কথা শুনে মনটা ভালো হয়ে যায়৷। এমন মানুষ এ জগতে এখনো আছে। আমি তাদের কথা মতো রাজি হয়ে যাই।
রুমে ফিরে পড়ায় মন বসাতে পারছি না৷ আমার তোতলামো কারণে কে হাসল? কে সে? পাশের রুমের মামুনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আমার তোতলামোর কারণে একজন তরুণী হুহু করে হেসে উঠল। তুই কি জানিস কে সে?
বন্ধু বলল, জানি বাড়িওয়ালার মেয়ে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বাড়িওয়ালার মেয়ে আছে?
হ্যাঁ আছে
একদিনও তো দেখলাম না।
দেখবি কেমনে তুই তো সবসময় মাথা নিচু করে চলাফেরা করিস? তাছাড়া সেও সবসময় বোরকা পরে স্কুলে যায়।
আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ এরপর মনে মনে মেয়েটাকে খুঁজতে থাকি। তারসাথে একদিন কথা বলে জানতে চাইব আমার তোতলামোর কারণে হাসল কেন?
একদিন বিকেলে খেয়াল করে দেখি বাড়িওয়ালার মেয়ে জানালা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দিকে আমার চোখ পড়তেই সে জানালার পাশ থেকে সরে যায়। একনজর তার রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।
এযেন মানবী নয় কোনো পরীরাজ্যের রাজকুমারী। তার চোখে দুটো এতই সুন্দর মনে হয়েছিল সে চোখের দিকে আজীবন তাকিয়ে থাকি৷
এরপর প্রায় খেয়াল করি আমার দরজা খোলার আওয়াজ শুনে সে বারান্দায় আসে। আমি বাড়ি ফিরলে জানালা খুলে তাকিয়ে থাকে। মাঝেমাঝে বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে আড়ালে আমাকে দেখে। আমিও এক গোপন সুতার টান অনুভব করি। ঘুরেফিরে তাকেই দেখি৷ দুজনে চোখে চোখে কথা হয়।
আমাদের মাঝে কোন ভাষার বিনিময় ছাড়াই দৃষ্টির মাধ্যমে চলে অজস্র প্রেমালাপ। আমি তার চোখের ভাষা বুঝি সেও আমার চোখের ভাষা বুঝে। এভাবে দু’জন দু’জনাকে দূর থেকে দেখে যাই কিন্তু কেউ কারো সামনাসামনি হয়নি।
হঠাৎ মেছের খাবার নিয়ে সমস্যা হয়। ওদের সাথে আমার বনিবনা হয় না। আবারো সিদ্ধান্ত নিলাম বাসা ছেড়ে দেব। আমি বাসা ছেড়ে দেব শুনে মাহফুজা মন খারাপ করে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে।
খবরটি বাড়িওয়ালার কানে যেতেই তিনি আমাকে ডেকে নেন। আমার মুখে সব শোনার পর তিনি বললেন, এখন থেকে তুমি আমাদের সাথেই খাবে। টাকা তুমি যা দেওয়ার দিয়ে দিও। এযেন মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি। আমি তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যাই। বাড়িওয়ালার তার স্ত্রী দুই ছেলে আমাকে তাদের নিজেদের একজন করে নেয়। বাড়িতে একজন গৃহকর্মী আছে। সে প্রতিদিন সময়মত আমাকে রুমে খাবার দিয়ে যায়।
দিনগুলো ভালই কাটছিল। প্রতিদিন একই সময় দু’জন দু’জনাকে দেখতাম। আর চোখে চোখে কথা হতো। একদিন সময়মতো তাকে দেখতে না পেলে আমি অস্তির হয়ে যেতাম।
চলবে…
এমআরএম/এমএস