শেখ হাসিনার অবদান, পদ্মা সেতু দৃশ্যমান

ইসমাইল হোসাইন রায়হান, স্পেন
তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আজ বিশ্বের কাছে পরিচিত বাংলাদেশ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ নিশ্চিতকরণ, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক পুলিশ বাহিনী, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাকা ধীরগতি হতে দেননি আমাদের সুপার অ্যানার্জেটিক প্রধানমন্ত্রী। যার নিরলস পরিশ্রমে আজ পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। সেতুটির নাম পদ্মা সেতু হলেও বাংলার মানুষ এটি শেখ হাসিনা সেতু হিসেবেই জানবে আমৃত্যু।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিক সূচনা করবে পদ্মা সেতু। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতে একে একে সেতু হয়েছে। মানুষের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। পণ্য পরিবহন গতি পেয়েছে। বড় বাধা ছিল পদ্মা পারাপার। এই নদী পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলায় যাতায়াতে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো মানুষকে, পণ্যবাহী ট্রাককে। পদ্মা সেতু হওয়ায় ছয়খাতে বিপ্লব ঘটবে। এগুলো হলো- সংযোগ স্থাপন, ব্যবসা-আঞ্চলিক বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, পর্যটন এবং সামাজিক খাত।
তেঁতুলিয়া থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ঢাকা হয়ে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে এই পথ যেতে একটা সময় আটটি ফেরি পাড়ি দিতে হয়েছে। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার আগে ফেরি ছিল নয়টি। আজকের দিনের পর কেউ তেঁতুলিয়া থেকে এই পথে যাত্রা করলে কোনো ফেরিই পাড়ি দিতে হবে না।
পদ্মা সেতুর কারণে ফেরি পারাপারের আর ভোগান্তি থাকবে না দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের জেলা সিলেটের জাফলং থেকে খুলনায় যাতায়াতের ক্ষেত্রেও। এই পথের দূরত্ব প্রায় ৫৬৫ কিলোমিটার। ২০০৩ সালে ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু চালুর পর সিলেট থেকে ঢাকায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পদ্মা সেতু চালুর ফলে হলে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ির ফেরি পারাপারও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে পারে।
বিশ্বের বুকে পোশাক এবং ক্রিকেটের পাশাপাশি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নতুন ব্র্যান্ড। যেসব বিশ্বরেকর্ড গড়ল পদ্মা সেতু:
১) পদ্মা সেতুর জন্য ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করা হয়েছে, যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। এত গভীরে আর নদীশাসনও কোথাও হয়নি।
২) পদ্মা সেতু নির্মাণে পিলারের ওপর স্প্যান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে, যা একটি বিশ্বরেকর্ড। ক্রেনটি চীন থেকে আনা হয়। এর ভাড়া গুনতেও রেকর্ড গড়া হয়েছে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘ সময় ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে।
৩) পদ্মা সেতুতে মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি।
৪) পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, না হয় স্টিলের।
৫) ৭১টি পাইলিংয়ে বেজ গ্রাউন্ড করতে ব্যবহৃত হয়েছে মাইক্রো ফাইন সিমেন্ট, যা পৃথিবীর অন্যতম দামি সিমেন্ট। সাধারণ সিমেন্টের বস্তা প্রতি দাম ৫৫০ টাকা, যা মাইক্রো ফাইনের দাম ১৫ হাজার টাকা। অস্ট্রেলিয়া থেকে এই সিমেন্ট আনা হয়েছে।
৬) পদ্মায় মূল সেতু, নদীশাসন ও সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজে মোট বালু ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ৬৫ লাখ ঘনমিটার, যা দিয়ে ১৯ কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবন তৈরি করা যাবে। এই আয়তন প্রায় ৫৭টি বুর্জ খলিফার সমান। বিশ্বের অন্যতম উঁচু ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফার সব তলা মিলিয়ে আয়তন ৩৩ লাখ ৩১ হাজার বর্গফুট।
কেন দরকার এই পদ্মা সেতুর?
১) কৃষি পণ্য আনা নেওয়ায় সুবিধা বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে।
২) স্থাপিত হবে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। দূর হবে বেকারত্ব।
৩) পদ্মা সেতু ২১টি জেলাকে সংযুক্ত করবে। বৃহত্তর বরিশাল জেলাকে একত্রিত করবে রাজধানী ঢাকার সাথে।
৪) সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা প্রতি বছর ৭-৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ৬৭ হাজার যানবাহন চলাচল করবে।
৫) দক্ষিণের জেলাসমূহের বার্ষিক জিডিপি ২.০ শতাংশ এবং দেশের সামগ্রিক জিডিপি ১.২ শতাংশের বেশি বাড়াতে সাহায্য করবে।
৬) ঢাকা থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় যেতে সময় সাশ্রয় হবে। কুয়াকাটা, তালতলীর টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা, বরগুনা, পাথরঘাটাসহ আশপাশের এলাকা, এমনকি সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।
পদ্মা সেতু বাঙালির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি এই সেতু বাঙালির জীবনের একটি বড় অর্জন। এই সেতুর সাথে মিশে আছে ১৭ কোটি বাঙালির সুখ-দুঃখ আর আর্থ-সামাজিক মুক্তির সোপান। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম সেই স্বাধীনতারও মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখানোর মতে দুঃসাধ্য কারো ছিল না। নিজস্ব অর্থায়নে এতো বড় বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখানোর সেই দুঃসাধ্য দেখালেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এমআরএম/এমএস