মিন্টো রোড ছাড়ুন দেশ গড়ুন

বাংলাদেশের বাইরে থাকলেও দেশের নানা সমস্যা প্রতিনিয়ত আমার চোখে পড়ে। ওইসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আগে খুঁজি সমস্যার কারণগুলো। একটি সমস্যার সঙ্গে আরেকটির সংযোগ রয়েছে। যেমন দুর্নীতির পেছনে রয়েছে সঠিক শিক্ষার অবনতি। বন্দুকযুদ্ধ বা খুন-খারাবির পেছনে বিবেকের অবক্ষয় এবং অতি লোভ জড়িত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ন্যায়বিচারের অভাব বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে এসব মূলত সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
যেদেশে এখনও শতভাগ মানুষের পেটে খাবার জোটে না, এখনও মানুষের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের শতভাগ নিশ্চয়তা নেই, এখনও শতভাগ মানুষের বাসস্থান নেই; যেদেশে এখনও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরা দেশের চিকিৎসা ব্যবহার না করে বিদেশি চিকিৎসার আশ্রয় নেয়; যেদেশে এখনও একজন গর্ভধারিণী মা জানে না তার পেটের বাচ্চার জন্ম সঠিকভাবে হবে কিনা। সেদেশে রাজধানীর মিন্টো রোডের পুরোনো সরকারি বাড়ি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বিষয়টি আমার নজর কেড়েছে দেশের গণমাধ্যমের খবর দেখে। গত কয়েকদিন আগে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদের এক সচিব সরকারের এ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন ‘গণপূর্ত বিভাগ ধীরে ধীরে মিন্টো রোডের বাড়িগুলো ভেঙে ফেলার চিন্তাভাবনা করছে। কারণ, এসব বাড়ি অনেক আগে নির্মিত। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের বাড়িতে সুইমিংপুলের পরিকল্পনার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন মিন্টো রোড এলাকায় যে কয়েক শ বাড়ি আছে, সব বাড়ির জন্য একটি সুইমিংপুল করা যায় কি না, দেখতে হবে।
‘এমনকি ইস্কাটন গার্ডেন অফিসার্স কোয়ার্টারে যে ছয়টি বড় ভবন আছে, সেগুলো ভাঙারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে’। বুঝলাম এসব বাড়ি মেরামত করতে হবে বা ভাংতে হবে। কিন্তু সবার জন্য আলাদা আলাদা বাড়ি করার কারণ কী? সবাইকে কি গণভবনের মতো সুযোগ করে দিতে হবে? আছে কি কোথাও এমনটি যদি আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিকাঠামোগুলো লক্ষ্য করি?
কথায় বলে পেটে ভাত নেই নাভিতে সিন্দুর? আর কত দিন চলবে এসব ধান্ধাবাজি? জাতির পেটে লাথি মেরে, দেশকে ডুবানোর ফন্দি ছাড়া এটা আর কী হতে পারে? এখনও এক কোটি রেমিট্যান্স আয়কারী সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে যে রাষ্ট্র ব্যর্থ, কীভাবে ভাবতে পারলো রাষ্ট্র্রের কর্মচারিরা সেই রেমিট্যান্স আয়কারী সৈন্যদের অর্থে প্রাসাদ তৈরি করার? এখনও সরকার এসব রেমিট্যান্স আয়কারী সৈন্যদের এয়ার পোর্টে নাজেহাল করে।
এখনও জনগণের অর্থে বিদেশে বসতরত বাংলাদেশের কূটনীতিকরা প্রবাসীদের সম্মান দেখাতে কৃপণতা করে অথচ তাদের অর্থে বিলাসী প্রাসাদ গড়ার স্বপ্ন দেখার সাহস কে দিলো এ রাষ্ট্রকে জানতে ইচ্ছে করে! ভবন যদি করতেই হয় তবে বহুতলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করে সবাইকে ফ্লাটে থাকার ব্যবস্থা করা হোক। ছোট্ট একটি দেশ যেখানে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। ঢাকাকে এখন দূষণমুক্ত, জনবহুল মুক্ত করতে হবে। তার জন্য দরকার জায়গার।
মিন্টো রোড়ের আশপাশে বাড়ি নয় বরং গাছপালা এবং জনগণের জন্য পার্ক করা হোক। জনগণকে শান্তি এবং স্বস্তি দিতে যেসব কল্যাণকর কাজ করা দরকার সেই দিকে নজর দিন। ওপরের সমস্যাগুলো শুধু যে বাংলাদেশে তা নয়; এ ধরনের সমস্যা কমবেশি সব দেশে লক্ষণীয়। এর মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশ এবং আফ্রিকার অনেক দেশ উল্লেখযোগ্য। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল দেখছি তার মধ্যে একটি জিনিস বেশ পরিষ্কারভাবে লক্ষ্যণীয়, সেটা হলো জাতীয় জীবনে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।
এখন প্রশ্ন, সামাজিক নিরাপত্তা কী এবং তা কীভাবে পাওয়া যেতে পারে? যেসব দেশে সামাজিক নিরাপত্তা রয়েছে তার স্বরূপ কেমন? সামাজিক নিরাপত্তা মানে জাতির ন্যূনতম একটি আয়ের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শিশু পুষ্টির ব্যবস্থা, বেকার ভাতা, ছেলেমেয়ের স্কুলের ব্যবস্থা, বৃদ্ধের ভাতা, শান্তি এবং স্বস্তিতে বসবাস করা, বলতে গেলে কমবেশি সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
যেসব দেশে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন- নিকটতম দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি। আবার যেসব দেশে উচ্চতম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন- সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব দেশে বলতে গেলে এর কিছুই নেই, যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ এর মধ্যে পড়ে।
দুর্নীতি, প্রশিক্ষণের অধঃপতন, চিকিৎসায় ফাঁকি, খাবারে ভেজাল এবং গুম এসব হয় এর মূল কারণ একটাই তা হলো এসব দেশের মানুষের জীবনে সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। আর নেই বলেই সবাই লুটপাট থেকে শুরু করে যত ধরনের অপকর্ম করা যায় তা করছে। ধর্মীয় কথা, জেলহাজতের ভয় দেখিয়ে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা ভুল হবে।
জাতির অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং সর্বোপরি তাদের বাকশক্তির স্বাধীনতার নিরাপত্তা দিতে না পারলে দেশের সমস্যার পরিবর্তন হবে না। মুখে মুখে বললে হবে না, জনগণ ক্ষমতার মালিক, হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখাতে হবে।
বাংলাদেশের পরিবর্তন আনতে হলে জনগণের ভালোবাসা, বিশ্বাস যদি সরকার অর্জন করতে না পারে তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, খুন-খারাবি, কুশিক্ষা এর কিছুরই পরিবর্তন হবে না।
মানুষের কাছে গণতন্ত্রের চাবি ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে সম্মানের সঙ্গে তাদের সামাজিক মৌলিক অধিকার এবং তারাই যে মাস্টার অব দ্য আর্ট তা প্রমাণ করে দেখাতে হবে। তাহলে সম্ভব বাংলার মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।
আমরা কি প্রস্তুত এমন একটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে?
আমি সুইডেনে থাকি, দেখছি এখানে কীভাবে বেকার ভাতা দিয়ে বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করছে। এখানে যদি কেউ লেখাপড়া করতে চায় তাকে সে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এখানে ভেজাল খাদ্যের কোনো উৎস নেই। এখানে দুর্নীতির জায়গা নেই। এখানে গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাক্টিস হচ্ছে প্রতিক্ষণ। সরকার দায়বদ্ধ তার মাস্টারের কাছে জবাবদিহি করতে এবং করছে। পুরো প্রশাসন জনগোষ্ঠীর জন্য ২৪ ঘণ্টাই তাদের সেবায় নিয়োজিত।
অথচ বাংলাদেশে ধর্ষণ, দুর্নীতি, মানুষ খুন, খাবারে ভেজাল মেশানো রয়েছে। জনগণকে তার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে এবং প্রশাসনকে জনগণের পাশাপাশি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেশকে সুইডেন বা নিউজিল্যান্ড করার স্বপ্ন দেখতে হবে এবং তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। তবে শুরু করতে গেলে নতুন ধরনের বাধা আসতে পারে। তাই একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, সেই একাত্তরের রক্তের দাগ এখনও আমার মতো অনেকের হাতে লেগে আছে এবং সেটা তারা কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না।
সেই রক্তের দাগ দুই ধরনের মানুষের মধ্যে এখনও বিরাজ করছে। যারা বাংলাদেশ চেয়েছিল এবং রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করে গেছে; আর যারা বাংলাদেশ চায়নি, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, লেখকের হাত কেটেছে, মানুষের চোখ তুলে নিয়েছে, মানুষের বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে নিয়েছে। তারা এবং তাদের বংশধররা এখনও বেঁচে আছে। এত বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু তারা একবারও নিজেদের দোষ স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। একাত্তরের ঘটনা আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের কাছে পুরোনো ঘটনা নয়; একাত্তরের ঘটনা আমাদের শরীরের রক্তক্ষরণ। আমি অনেক কিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করি, কিন্তু এই একটি ব্যাপার আমি কখনও ভুলিনি।
সবকিছু জেনে শুনে, নতুন করে একত্র হয়ে, দেশের স্বার্থে, অতীতের কথা ভুলে, আর পুরোনো স্মৃতি মনে রেখে, সম্ভব হবে কি আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দেশ গড়ার কাজে! আমি বিশ্বাস করি সেটা সম্ভব হবে। দেখুন ফিনল্যান্ডকে, অল্প বয়সের নতুন প্রজন্মের একটি মেয়ে, প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন নতুন করে ভাবছেন তার দেশকে নিয়ে। তিনি স্যুট পরে নয় জ্যাকেট পরে নিউ লুক, নিউ ইমেজ নিয়ে নেমেছেন পরিবর্তনের জন্য।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জেআইএম