হৃদয় অনুভব করে প্রকৃতির সৌন্দর্য

প্রথমে মনে হবে প্রতিটি বিচ প্রায় একই রকম দেখতে। যদি বলি বাংলাদেশের সবাইকে দেখতে অনেকটা ইন্ডিয়া বা পাকিস্তানিদের মতো লাগে তাহলে অনেকে ক্ষেপে যাবে কারণ তার মধ্যে পার্থক্য বা ভেদাভেদ করার মতো বোধগম্যতা তৈরি হয়নি। যা কিছু দেখি না কেন তাকে হৃদয় দিয়ে দেখতে হবে, ভাবতে হবে, অনুভব করতে হবে, তারপর শুধু পার্থক্য নয় স্রষ্টার ক্ষমতা, দক্ষতা, মহানুভবতাসহ সবকিছু বোঝা যাবে।
রাইলি বিচের একটি পাহাড় কল্পনায় দেখতে পুরুষ অঙ্গের মতো মনে হবে, যদি ওই ভাবে চিন্তা করা হয়। অতীতে এমনটি করে বৌদ্ধ জাতি চিন্তা করেছে, যার ফলে সেই পাহাড়ের নিচে একটি গহীন সুড়ঙ্গ রয়েছে যা সমস্ত বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য একটি যৌন মন্দিরে পরিণত হয়েছে। অনেকেই সেই মন্দিরে এসে ফুলের মালাসহ নানা বিনোদনের জিনিসপত্র রেখে মনে মনে নিশ্চয়ই কিছু চেয়ে থাকে।
একটি মেয়েকে পূজা করতে দেখলাম, তার পূজা শেষ হলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম পুরুষ জাতি না হয় তাদের যৌন অঙ্গ বড় হয় সেই কারণে এখানে আসে তা তুমি কি কারণে পূজা করছো? মেয়েটি হেসে দিয়ে বললো আমি এসেছি আমার স্বামীর যেটা আছে সেটা যেন ঠিকমতো কাজ করে। কিছুক্ষণ বিনোদনের এই আলোচনা শেষ করতেই দেখলাম পরে শুধু বৌদ্ধ নয় নানা ধর্মের লোকের ভিড় সেখানে।
আরও দুটি দ্বীপ যেমন ট্যুব এবং মোর দ্বীপ। জোয়ার ভাটার কারণে পানি যখন কমতে থাকে তখন এই দুই দ্বীপের পাহাড়ের মধ্যে চমৎকার রাস্তা তৈরি হয় যাকে থাইল্যান্ডে বলে ‘Unseen in Thailand’ এই মিরাকেল রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন দুই পাশে সাগর আর মাঝখানে এই পথ, পথের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে যে কী মজা ছিল সে অনুভূতি না আসলে তো হবে না। পাহাড় দুটির দূরত্ব খুব একটা বেশি না, ত্রিশ খেকে চল্লিশ মিনিটের দূরত্ব হবে।
সকালে বোটে করে দ্বীপ দুটো ভ্রমণ করেছি, তখন ছিল পানিতে ভরা, পরে বিকেলে এসে দেখি দ্বীপ দুটোর মাঝে স্বচ্ছ বালুর ঝকঝকে রাস্তা। নৌকা ছাড়া এক দ্বীপ থেকে অন্যদ্বীপ যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন মনে পড়ে গেলো সেই মুসা (আ.) নবীর বিস্ময়কর গল্পের কথা। তিনি তার সময় সাগরকে দুই ভাগে ভাগ করে মানুষ জাতিকে অবাক করেছেন। আমি স্রষ্টার ক্ষমতা দেখে অভিভূত হয়েছি একইসাথে ভেবেছি জোয়ার ভাটার ক্ষমতা, মমতা এবং দক্ষতা সম্পর্কে।
আমরা আরও যে দ্বীপগুলো ভ্রমণ করেছি তার মধ্যে রয়েছে মায়া বে দ্বীপ, হং দ্বীপ, হং লাগুন, চিকেন এবং পাদা দ্বীপ। মনে কি পড়ে লিনওনার্দো ডিক্যাপ্রিও তার ফিল্ম ‘দ্য বিচ’ ছবির কথা? এই ছবি করে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। মূলত মায়া বেতে পুরো ছবির সুটিং হয়েছে। মায়া বের চেয়ে সুন্দর কোনো বিচ আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তারপর যেসব দ্বীপের সঙ্গে ভালোবাসা গড়ে উঠেছে তার মধ্যে হং দ্বীপ এবং হং লাগুন, চিকেন এবং পাদা দ্বীপ উল্লেখযোগ্য।
হং দ্বীপে স্নোরকেল করা, ব্লু লাগুনে কিছুক্ষণ সময় কাটানো এবং মাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ছিল এক বিশাল ঘটনা। সাগরের নানা রঙয়ের মাছগুলো যখন আমাকে ঘিরে আছে তখন সবার চোখ আমার দিকে। সবাই ভাবছে কীভাবে সম্ভব? আমার মনে হচ্ছিল একটু রুটি দিলে নিশ্চয় মাছ আসবে, যে ভাবনা সেই ফল। অত মাছ সেদিন আমার চারপাশ ঘিরে ছিল যা দেখে অনেকেই আনন্দ উপভোগ করেছিল।
পুকেট দ্বীপ পানি পথে খুব একটা বেশি দূরে নয়। সেখানে মূলত গিয়েছিলাম জেমস বন্ড দ্বীপ দেখতে। কী রহস্য রয়েছে হাজার দ্বীপের মাঝে জেমস বন্ড দ্বীপে এবং কেন জেমস বন্ড মুভিতে এই দ্বীপ বেছে নিয়েছে? দ্বীপটিকে দেখলেই বোঝা যায় কেন জেমস বন্ড নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে জেমস বন্ডের ‘দ্য ম্যান উইদ দ্য গোল্ডেন গান’ চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হয় এই দ্বীপে। সেই থেকে এটা বেশ বিখ্যাত এবং নামও হয়ে গেছে জেমস বন্ডের নামেই।
হঠাৎ একদিন ল্যাঙ্কবী দ্বীপে যে দ্বীপ মূলত মালয়েশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন, অতীতে সেখানে ঘুরেছি এবং দেখেছি সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের দেখা দ্বীপটি। ল্যাঙ্কবি দ্বীপের ওপর আমার একটা লেখা রয়েছে যা অতীতে পাবলিশ হয়েছে নানা পত্রিকায়।
ভ্রমণ শেষ হবার তিনদিন আগে আমরা পিপি দ্বীপ ভ্রমণে আসি। পিপি অ্যাইল্যান্ডে দেখার মতো রয়েছে কয়েকটি ছোট বড় ব্লু লাগুন যা সত্যিই চমৎকার। আগেই বলেছি প্রকৃতিকে যদি ভালোবাসা না যায় তবে জানি না অর্থ এবং সময় নষ্ট করা ঠিক হবে কিনা! ভালোবাসা ধরা বা ছোঁয়া যায় না তবে তা অনুভব করা যায়। আমার মনে হয় প্রকৃতি যেমন দেখা যায় তেমন অনুভব করা যায়। শুধু অনুভবে হৃদয় অনুভব করে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে।
পিপি দ্বীপ ভ্রমণ শেষে ফিরতে পথে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয় সাগরের মাঝে। সবাই একটু ভয়ে আছি তারপর প্রচন্ড গরম। পরে চড়া বৃষ্টিতে ভিজে হোটেলে ঢুকতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেলো। সূর্যকে আজ আর দেখা যাবে না। হোটেলে ঢুকেই তাড়াহুড়ো করে গোসল শেষ করলাম সবাই। ডিনার খেতে যাব।
হঠাৎ মারিয়ার প্রচণ্ড জ্বর। দুইদিন আগে থেকেই তার মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা করছে, আমরা ভেবেছি প্রচন্ড গরম তারপর অনিয়মিত বৃষ্টি, ঠান্ডা লাগতে পারে। সাধারণত এসময় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কারণ এখন এখানে শীত, কিন্তু দুঃখের বিষয় জলবায়ুর এমনভাবে পরিবর্তন হয়েছে বোঝা কঠিন কখন কী হয়। আমরা নিজেরাই যখন নিজেদের শত্রু হয়েছি তখন কার কী আসে যায় পৃথিবী ধ্বংস হলে!
এমআরএম/এএসএম