মেলবোর্নে প্রবাসী নারীদের মিলনমেলা

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন
প্রকাশিত: ০১:২১ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০২৩

গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরানোর সময় কানে আসলো কাঁচের চুড়ির রিনঝিন শব্দ, নিজেই যেন খানিক সময়ের জন্য কোথাও হারিয়ে গেলাম, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের পর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ কাঁচের চুড়ির শব্দ, যাত্রার শুরুতেই মন ভালো হয়ে গেলো। সেদিনই জীবনে প্রথম রেশমি চুড়ি পরে গাড়ি চালিয়েছিলাম। আমাদের প্রবাস জীবন যেমন যন্ত্রের মতো চলে, চুড়ি পরবার সময়ই তো হয় না, আর তো কাঁচের চুড়ি! কিন্তু দেশি বোনদের অনুষ্ঠান বলে কথা।

গেলো শনিবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে ছিল মেলবোর্নে বসবাসরত বাংলাদেশি মেয়েদের ঈদের দিন যেন, সবাই এতটাই খুশি, প্রাণবন্ত আর ঝলমলে রঙিন। অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি মেয়েদের ফেসবুক বেইজড গ্রুপ ‘‘Aussi Bangla Sisterhood’’ এর বাৎসরিক অনুষ্ঠান ‘‘sisterhood Fest’’ মেলবোর্নের Williamstown ar Townhall অনুষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞাপন

সাধারণত ভিড়বাট্টা এড়িয়ে চলি, এবার দুই বান্ধবীর গুতাগুতিতে যেতে রাজি হলাম, যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি হলো যে টিকিট শেষ, কিন্তু কপাল যেহেতু চওড়া তাই এমন বান্ধবীও আছে যে টিকিট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও শেষ মুহূর্তে টিকিট খুঁজে দিলো।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

একগাদা সেজেগুঁজে রওনা হলাম। দেশি মেয়েদের অনুষ্ঠান মাথায় রেখে পরে গেলাম দেশি প্রিয় শাড়ি জামদানি, দেশি রুপার গয়না, দেশি রেশমি কাঁচের চুড়ি।

সময়মতো যাওয়ার জন্য গাড়ি পার্কিং পেয়ে গেলাম বেশ সহজে, ঢোকার পথেই মন ভালো হয়ে গেলো, অনেক অনেক চেনা মুখের হাস্যজ্জ্বল মুখচ্ছবি, যেন ঈদের দিন, দেখা হলো অনেকের সঙ্গে, অনেক ব্যাচমেট বন্ধুদের সঙ্গে, রৌদ্রজ্জল একটা দিন গেলো অডিটোরিয়ামের ভেতরে বাইরে এবং সবার অন্তরে অন্তরে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

‘‘Aussi Bangla Sisterhood’’ গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন মেলবোর্নের মিষ্টি মেয়ে জান্নাত ফেরদৌস ২০১৫ সালে এক মন খারাপের বিকেলে হুট্ করে গ্রুপটা খোলেন। মা-বাবা আত্মীয়-পরিজন ফেলে বাংলাদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েদের প্রবাসের এই কষ্টকর জীবনে মনের কথা বলার একটা আপন জায়গা হোক, যেখানে সবাই সবার সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা ভাগাভাগি করে নেবে এই চিন্তা থেকে। আস্তে ধীরে জান্নাতের সেই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা এখন তেরো হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখন প্রতিদিনকার পোস্ট অপ্প্রভাল ও মান তদারকির জন্য রয়েছেন ছয়জন স্টেট থেকে ছয়জন মডারেটর।

ফেসবুকে তো শতশত গ্ৰুপ, তার মাঝে আলাদা করে এই গ্রুপের বৈশিষ্ট কী?

বিজ্ঞাপন

বৈশিষ্ট হলো এই গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে আসা সকল মেয়েদের পরম আস্থার একটা জায়গা। কেউ চাকরি খুঁজছেন, নতুন ব্যবসায় পা দেবেন, কেউ পড়াশোনা করতে চান, কোন বিষয় ভালো হবে বা কেউ বাচ্চা পালতে হিমশিম খাচ্ছেন, এখন কী করবেন? জানতে চেয়ে স্ট্যাটাস দেন, শত শত কমেন্টে হরেক রকম সমাধান হাজির। বেছে নেন আপনার পছন্দ মতো।

এছাড়াও, কারো পার্টনার খারাপ ব্যবহার করছে দিনের পর দিন গৃহস্থালি বা মানসিক নির্যাতনের স্বীকার, লিগ্যাল সাহায্য লাগবে, কারো বাচ্চার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, কীভাবে কাজে যাবেন, মা-বাবা দেশ থেকে আসবেন, পরিচিত কাউকে খুঁজছেন। কারো কোনো শারীরিক সমস্যা বা অসুস্থতা, ডাক্তারি পরামর্শ, মন খুবই বিষণ্ণ, কীভাবে ভালো হবে? বাচ্চা কথা শোনে না, কী উপায়? আর্থিক সমস্যা, সমাধান কী?

বিজ্ঞাপন

থাকার জায়গা নেই, কোথায় যাবে? ভালো আইনজীবী বা কাউন্সেলিং কোথায় বসেন? কোন ইউনিভার্সিটি বা স্কুল ভালো, ড্রাইভিং শিখবেন কোথায় বা ভয় দূর করবেন কী করে ইত্যাদি শেষ না হওয়া হাজারটা সমস্যার সমাধানে এই গ্রুপ খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখে কেননা এখানে রয়েছে সবধরনের পেশার মানুষ যারা খুবই আন্তরিকতার সাথেই দেশি বোনদের দিকে সব ধরনের সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেন।

ব্যবসায়ী ও উদ্যোগী মেয়েদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য আছে পণ্য রিভিউ নিয়ে পোস্টও থাকে, কারো কোনো বিশেষ নকশা বা রঙের পোশাক বা কোনো দেশি খাবার খুঁজছেন, সেটা কোথায় পাবেন জানতে চেয়ে পোস্ট, কমেন্টস এই সমাধান।

এছাড়া পোস্ট হয় সচেতনতামূলক প্রবন্ধ, ধর্মীয়কাজে কীভাবে উৎসাহ বাড়ানো যায়, সামাজিক গল্প, কবিতার পাশাপাশি অনেক কৌতুক বা মজার পোস্ট। রয়েছে অভিযোগমূলক পোস্টও যেন অন্যরা সচেতন হয়।

বিজ্ঞাপন

আমি নিজেই আমার অনেক লেখার জন্য ইনবক্সে অচেনা অজানা আপুদের সালাম ও ধন্যবাদ পেয়েছি, এ এক অন্যরকমের ভালোলাগা যা কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না।

শনিবার অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল বেলা সাড়ে ১২টায়, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে, অনুষ্ঠানটির টাইটেল স্পনসর ছিল ‘অলব্রাইট ইনস্টিটিউট’। এরপর স্টেজে কথা বললেন অ্যাডমিন জান্নাত ফেরদৌসসহ উপস্থিত অন্য মডারেটররা।

বিজ্ঞাপন

সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে একটা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো, মেলবোর্নের উইলিয়ামস্টাউন টাউন হলে সত্যিই সব তারার মেলা বসেছিল যেন। প্রত্যেকেই এত বেশি হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত ছিলেন যেন সবাই সবার কত চেনা। এমনি করেই টিকে যাক গ্ৰুপটি, পরিসর আরও বড় হোক, দেশে বড় হওয়া বাড়ির প্রিয় মেয়েটি প্রবাসের দমবন্ধ করা জীবনে শ্বাস নিতে পারে, দেশ থেকে আসা মেয়েদের অতি ব্যস্ত জীবনে গ্রুপটি দক্ষিণের জানালা হয়ে খোলা থাক।

অ্যাডমিন জান্নাত ফেরদৌসসহ তিন স্টেটের তিন মডারেটর, মেলবোর্নের মিলডুরা থেকে ড. জান্নাত ফেরদৌস, সিডনি থেকে তিশা জেবিন আর পার্থ থেকে প্রমা উপস্থিত ছিলেন। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন ড. জান্নাত এবং সেজুতি জামান, টেকনিকাল টিমে ছিল প্রমা ও তাহাসিনা।

আয়োজনটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার পেছনে স্পন্সরদের ভূমিকা অপরিসীম। প্রোগ্রামের টাইটেল স্পন্সর ছিলো ‘‘Albright Institute of Business and Language’’। ডায়মন্ড স্পন্সর ‘‘SheRiz Fashion House Sarebee’’, সিলভার স্পন্সর Meal deal au Nabila Nabila & রিফাত হাসান- Finance Broker & ড. রেশমি।

ছবি তোলার জন্য সাজানো হয়েছিল সুন্দর দুটি ফটোবুথ, সৌজন্যে ‘‘Fun n Festive Events by D’’ এবং ‘‘Star Event & Decorations’’

পুরো অনুষ্ঠানের ফটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিল মেলবোর্নের বিখ্যাত Subirs Photography & GoZ Photography Melbourne. খাবার কেটারিংয়ের দায়িত্বে ছিল Bangladeshi Cuisine.

সেমি ক্লাসিকাল নাচ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করে নৃত্যশিল্পী গঙোত্রী এবং তার দল। বাংলা আর ইংরেজির ফিউশান নিয়ে আসে উর্মি, সেঁজুতি, ফারিহা আর অদিতি। বাংলা ফোক গানের রিমিক্স করে সুন্দর নাচ করেছেন সিডনি থেকে তিশা, নুসরাত, ফারিহা। আর সব শেষে ছিলো ট্রিবিউট টু বলিউড, যেখানে নৃত্যপরিবেশন করেন নৃত্যশিল্পী সাঈদা সায়েরা ও স্বর্ণাসহ আরও এক ঝাঁক শিল্পী।

গানের আয়োজন ছিল ২টি, বাংলা ব্যান্ডের দুটি অসাধারণ গান নিয়ে আসেন গায়িকা রায়হানা মিশু আর সালমান শাহের কয়েকটা চিরচেনা গান নিয়ে একটা ম্যাশাপ করেন গায়িকা সারিতা।

মেয়েদের নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি শীর্ষক একটা ভিন্ন রকম পরিবেশনা, আবৃত্তিতে ছিলেন সুবর্না। শেষে কুইজ ও গেম যোগ দিয়েছিল বাংলা আর বলিউডের চার খান যা ছিলো সবার জন্য সারপ্রাইজ।

একেবারে শেষ আয়োজন ছিল ডিজে ড্যান্স। বিভিন্ন ধরনের ধুম ধাড়াক্কা জনপ্রিয় গানের সঙ্গে এবং মনখুলে নেচে গেয়ে শেষ হলো এইবারে Sisterhood Fest. কেউ নাচলেন, কেউ ঠোঁট মিলিয়ে গাইলেন, কেউ হাততালি দিলেন, কেউ চুপচাপ বসে উপভোগ করলেন, কেউবা তুললেন ছবি কিন্তু দিন শেষে পড়ন্ত বিকেলে সবারই মুখ হাসি হাসি। ঠিক যেন রবিঠাকুরের গান...

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান
আন তবে বীণা, আ....
সপ্তম সুরে বাঁধ তবে তান।’

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com