ইয়াসিনের গল্প
প্রবাসীরা শুধু দিয়েই যাবে বিনিময়ে তাদের পাওয়ার কিছু নেই

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাঞ্ছারামপুরের মোহাম্মদ ইয়াসিন। পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে যার পড়ার টেবিলে বসার কথা সে ২০২৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে কুয়েত পাড়ি জমায়। বাবা সিনএনজি চালক। অভাবের সংসারে দুই ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করানো সম্ভব হচ্ছে না ইয়াসিনের বাবার। বাধ্য হয়ে ছেলেকে পাঠিয়ে দেন বিদেশে। ছেলেও কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নেয় হাসিমুখে। তবে, ইয়াসিনের কুয়েতে আসা মোটেও সহজ ছিল না। জানবো তার এই গল্প।
অভাবের সংসার। ইয়াসিনের বাবার কোনো জমিজমা নেই। কুয়েতে আসার জন্য লাগবে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। নিম্নবিত্ত পরিবারটি এত টাকা পাবে কোথায়? শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঋণ নিয়ে ভিসার টাকা জমা দেয় দালালের হাতে। সিএনজি চালক বাবার সাধ্য নেই সেই ঋণ শোধ করার। দিনে যা আয় হয় তাই তো খরচ হয়ে যায়। ইয়াসিনকে বিদেশ আসার জন্য দিতে হবে মেডিক্যাল টেস্ট। কিন্তু এতে বাধে যত বিপত্তি। যতবারই মেডিক্যাল দিচ্ছে ততবারই আনফিট। শেষ পর্যন্ত ফিট দেখিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছে দালাল চক্র।
- আরও পড়ুন
- শ্রমিকদের কতটা কল্যাণ করছে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন?
- শ্রমিকদের জীবনচক্র আটকে আছে চা বাগানের গণ্ডিতে
কুয়েত আসার পর ৭৫ দিনার বেতনে ডিউটি শুরু। দুই মাস ডিউটি করার পর কোম্পানি একমাসের বেতন দিলেও অন্য মাসের বেতন দেয়নি। এর মধ্যে আবারো কুয়েতে মেডিক্যাল টেস্ট দিতে হয়েছে দুইবার। তাতে আবারও আনফিট। এবার কোম্পানি বললো ৩৫ দিনার জমা দিতে। আনফিট হওয়ায় একামা লাগবে না, তাই তাকে দেশে পাঠিয়ে দেবে। একথা শোনার পর আকাশ ভেঙে পড়লো ইয়াসিনের মাথার ওপর। সাড়ে ৬ লাখ টাকা দিয়ে এসে মাত্র দুই মাসের মাথায় দেশে ফিরতে হবে তাও আবার ৩৫ দিনার জমা দিয়ে, যেখানে সে সময় নিজে খরচ করার মতো টাকা নেই তার কাছে।
নিরুপায় হয়ে ইয়াসিন চলে আসলো কুয়েত সিটি থেকে দূরবর্তী এক মরুভূমিতে। যেখানে ইট পাথরের কোনো ছোঁয়া নেই। আছে শুধু ধু-ধু মরুভূমি। লেগে যেতে হলো কাজে। যেখানে তার এই বয়সে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা, খেলাধুলা আর পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে তার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হলো সাড়ে ছয় লাখ টাকার ঋণের বোঝা। তাও আবার সারাদিন থাকতে হবে পুলিশের ভয়ে। না জানি কখন ধরে নিয়ে যায়! ধরতে পারলে তো দেশে পাঠিয়ে দেবে।
তাড়াতাড়ি বিষয়টি জানালো ভিসা দেওয়া সেই দালালকে। দালাল যেহেতু বাড়ির পাশের কিছুটা হলেও তার দায়বদ্ধতা আছে। না হয় পরিবারটি পথে বসে যাবে। এতগুলো টাকার ঋণ তার বাবার পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। ইয়াসিনের একদিকে ঋণের চিন্তা আরেকদিকে পরিবারের চিন্তা। ১৭ বছর বয়সে যা তাকে অসহনীয় করে তুলেছিল। দালাল তাকে সেখান থেকে তড়িঘড়ি নিয়ে আসলো এক মরুভূমিতে। যেখানে তাকে থাকতে হবে অবৈধ হয়ে। আর না হয় তাকে দেশে ফিরতে হবে।
দেশের কথা মনে পড়লে সে অজান্তে কাঁদে। তবুও কাউকে বুঝতে দেয় না। পরিবারের যখন যা প্রয়োজন ধারদেনা করে হলেও তা মেটানোর চেষ্টা করে। তাকে দেখলে অন্যদের মায়া হয়। এত অল্প বয়সে এত পরিশ্রম। নিজের সুখ-শান্তি সব বিসর্জন দিয়ে এভাবে কতদিন চলবে সে? চাইলেও তো অন্যদের মত ছুটিতে দেশে যেতে পারবে না। যেতে হলে একবারে চলে যেতে হবে। আবার ঘুরতে চাইলেও বের হতে পারে না পুলিশের ভয়ে। ইয়াসিনের মতো এমন হাজারো প্রবাসী এভাবে দিন কাটাচ্ছে। ইয়াসিনরা শুধু দেশ আর পরিবারকে দিয়ে যাবে। বিনিময়ে তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
নিরুপায় হয়ে ইয়াসিন চলে আসলো কুয়েত সিটি থেকে দূরবর্তী এক মরুভূমিতে। যেখানে ইট পাথরের কোনো ছোঁয়া নেই। আছে শুধু ধু-ধু মরুভূমি। লেগে যেতে হলো কাজে। যেখানে তার এই বয়সে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা, খেলাধুলা আর পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে তার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হলো সাড়ে ছয় লাখ টাকার ঋণের বোঝা। তাও আবার সারাদিন থাকতে হবে পুলিশের ভয়ে। না জানি কখন ধরে নিয়ে যায়! ধরতে পারলে তো দেশে পাঠিয়ে দেবে।
প্রবাসে প্রায়ই দুই বছর হতে চললে ইয়াসিনের। এরমধ্যে একটিবারের জন্যও মরুভূমি থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেল না। যেন এক কারাগারে তার জীবন যাচ্ছে। সব ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে তাকে ছুটতে হচ্ছে টাকার পেছনে। এরমধ্যে ঋণের টাকাও পরিশোধ করলো। পরিবারের ইচ্ছা পূরণে নিজের শখ আহ্লাদ ভুলে গেল সে। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম শেষে বাসায় ফিরে আবার রান্নাবান্না। এরপর যখন মা-বাবার সাথে কথা বলে নিমিষেই যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় তার। পরিবার হাসিখুশি থাকার মাঝেই তার প্রকৃত সুখ।
দেশের কথা মনে পড়লে সে অজান্তে কাঁদে। তবুও কাউকে বুঝতে দেয় না। পরিবারের যখন যা প্রয়োজন ধারদেনা করে হলেও তা মেটানোর চেষ্টা করে। তাকে দেখলে অন্যদের মায়া হয়। এত অল্প বয়সে এত পরিশ্রম। নিজের সুখ-শান্তি সব বিসর্জন দিয়ে এভাবে কতদিন চলবে সে? চাইলেও তো অন্যদের মত ছুটিতে দেশে যেতে পারবে না। যেতে হলে একবারে চলে যেতে হবে। আবার ঘুরতে চাইলেও বের হতে পারে না পুলিশের ভয়ে। ইয়াসিনের মতো এমন হাজারো প্রবাসী এভাবে দিন কাটাচ্ছে। ইয়াসিনরা শুধু দেশ আর পরিবারকে দিয়ে যাবে। বিনিময়ে তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। কারণ তারা প্রবাসী।
এসএইচএস/জিকেএস