বন্ধু ছাড়া লাইফ সত্যিই অসম্ভব

রাকিব হাসান রাফি
রাকিব হাসান রাফি রাকিব হাসান রাফি , স্লোভেনিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:৫৫ পিএম, ০১ এপ্রিল ২০২১

প্রায়ই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক করে। আর সেটি হচ্ছে; কোনো ছেলে কী কোনো মেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে না? ঠিক একইভাবে যদি আমি বিপরীত দিক থেকে প্রশ্নটি করি তাহলে বিষয়টি দাঁড়ায় কোনো মেয়ে কী কোনো ছেলের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে না?

সরল ভাষায় এ প্রশ্নটির উত্তর কোনোভাবে দেয়া সম্ভব নয়। এটি স্বীকার করতে হবে যে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে অনেকটা রক্ষণশীল, ইউরোপ কিংবা আমেরিকা অথবা অস্ট্রেলিয়ার সমাজব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে আমাদেরকে কোনোভাবে উদার বলা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে তবে আমাদের দেশে নারী ও পুরুষের মাঝে যে বৈষম্য সেটি আশানুরূপভাবে এখনও দূরীভূত হয়নি। বিপরীত লিঙ্গের দুইজন মানুষের মধ্যাকার বন্ধুত্বকে এদেশের অনেকে এখনও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন না।

তবে যদি বিষয়টি ইউরোপ কিংবা পাশ্চাত্য দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থার নিরিখে চিন্তা করি তাহলে বিপরীত লিঙ্গের দুইজন মানুষের মধ্যকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক তেমন একটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। এজন্য যে পরস্পরকে কোনো ধরনের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হবে সে বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ফেসবুকের কল্যাণে আমার সঙ্গে ইরেনা প্রোসহিচ নামক এক তরুণীর পরিচয় হয়। ইরেনা বর্তমানে মেসিডোনিয়ার অধিবাসী এবং পেশায় তিনি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। একজন ছেলে একজন মেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে কি এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, অবশ্যই একজন ছেলে একজন মেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে।

এজন্য যে তাদের মাঝে কোন ধরনের সম্পর্ক থাকতে হবে সে বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। জীবনে চলার ক্ষেত্রে যে কোনো সময় একে-অন্যের কাছে আসতে পারে এবং এভাবে পরস্পরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে।

ইরেনা বলেন, এটা ঠিক যে মেসিডোনিয়া, গ্রিস, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া কিংবা আলবেনিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান দেশগুলোতে এখনও নারী ও পুরুষের অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনও বেশ কিছু জিনিস প্রচলিত রয়েছে যা আপনি পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে কখনও খুঁজে পাবেন না।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যেমন- আমাদের দেশে কোনো ছেলে যদি কোনও মেয়েকে ডেটিং এর জন্য প্রস্তাব দেন এবং তাকে কোনও রেস্টুরেন্টে আমন্ত্রণ জানান, তাহলে এখানকার সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী আপনাকে ওই মেয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এমনকি রেস্টুরেন্টে খাবার গ্রহণ শেষে তার বিলও আপনাকে পরিশোধ করতে হবে।

পারিবারিক বিভিন্ন প্রথার ওপর আমরা এখনও আস্থাশীল। কেননা আমাদের জীবনে অর্থোডক্স চার্চগুলোর প্রত্যক্ষ প্রভাব আজও জোরালো। তাই মেয়েদের বিয়ের পূর্বে অভিভাবকেরা ছেলের সক্ষমতা যাচাই করে।

ইরেনার মতে, আমাদের সবার উচিত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সবাইকে সমানভাবে দেখার চেষ্টা করা এবং সবাইকে একই রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা।

বিজ্ঞাপন

এ প্রসঙ্গে তিনি যোগ করেন, মানুষকে মূল্যায়ন করা উচিত তার মানবীয় গুণাবলি দ্বারা, তার কর্মের দ্বারা। কে নারী কিংবা কে পুরুষ এ বিষয়টি কোনোভাবে বিবেচনায় আনা উচিত নয়। আপনার সাথে যদি কারও মতের মিল হয় তাহলে অবশ্যই আপনারা একে-অন্যের কাছাকাছি আসতে পারেন।

নিজেদের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করতে পারেন, মনের মধ্যকার না বলা কোনো কথা নিয়েও পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করতে পারেন। একসাথে ঘোরাঘুরি করতে পারেন, আড্ডা দিতে পারেন এবং যে কোনও প্রয়োজনে বন্ধুত্বের দায়িত্ববোধ থেকেই একে-অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারেন।

ইরেনার এ বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা একমত পোষণ করেছেন নেদারল্যান্ডসের অধিবাসী রবিন কালইয়াও। তিনি বলেন, যে কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে আপনারা একে অন্যের মতামতের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল।

বিজ্ঞাপন

কে নারী কিংবা কে পুরুষ এ বিষয়টি বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে কখনও বিবেচনায় আনা উচিত নয়। একজন মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে সবার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করুন, পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরুন। নিজেদের মধ্যকার বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন।

রবিনের মতে যে কোনো কিছুকে দেখতে একটি জিনিসের প্রয়োজন আর সেটি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের অবস্থান থেকে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য কাজ করা। এভাবে যদি আমরা সামষ্টিকভাবে কাজ করতে পারি তাহলে একদিন আমরা আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারব যেখানে কোনো ধরনের বিভেদ, বৈষম্য কিংবা অপরাধ থাকবে না।

ভিক্টোরিয়া স্কুইলার একজন ব্রাজিলিয়ান নাগরিক যিনি সোশিয়লজির ওপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি ‘জেন্ডার ইনিকুয়ালিটি ইন ল্যাটিন আমেরিকান কান্ট্রিজ’ এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোর অধীনে পিএইচডি সম্পন্ন করছেন।

বিজ্ঞাপন

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একবিংশ শতাব্দীর এ যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্য বিদ্যমান। আমরা যদি আমাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন করতে পারি তাহলে অনেকাংশে এ বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব।

রবিন ও ইরেনার মতো তিনিও মনে করেন নারীকে নারী এবং পুরুষকে পুরুষ হিসেবে বিবেচনা না করে সবাইকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি দেখেছি পৃথিবীর অনেক দেশে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সহশিক্ষার বিষয়টি অনেক রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় এখনও সেভাবে গৃহীত হয়নি।

বিজ্ঞাপন

আমি মনে করি উন্নয়নশীল দেশগুলো সহশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে পারে। সহশিক্ষার ফলে ছেলে ও মেয়ে উভয়ই একে অন্যের কাছে আসার সুযোগ পাবে এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে। ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেও তিনি সহশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

মানুষের জীবনের সর্বপ্রথম অভিজ্ঞতার নাম বন্ধুত্ব। পারিবারিক কিংবা সামাজিক যে কোনো সম্পর্ক কখনও বিকশিত লাভ করে না যদি না এ সম্পর্কের মাঝে ‘বন্ধুত্ব’ এ বিষয়টির উপস্থিতি না থাকে।

ইংরেজি সাহিত্যের লেখক ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, কেউ কেউ পুরোহিতের কাছে যায়, কেউ কবিতার কাছে, আমি যাই বন্ধুর কাছে। বন্ধু ছাড়া লাইফ সত্যি ইমপসিবল। তবে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা অত্যন্ত রক্ষণশীল। এজন্য অনেক সময় দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর ছেলে মেয়ের মধ্যকার স্বাভাবিক মেলামেশাকেও আমাদের মুরুব্বিরা সেটিকে ভালো চোখে দেখেন না।

এমনকি বিয়ের পরও যদি কোনো মেয়ে তার কোনো ছেলে বন্ধু কিংবা অফিসের কোনো ছেলে সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাহলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সেটিকে ভালোভাবে দেখেন না। একইভাবে বিয়ের পর কোনো ছেলেও যদি তার মেয়ে বন্ধু বা অফিসের কোনো মেয়ে সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন সেটিকেও পরিবারের সদস্যরা ভালোভাবে নেয় না।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

এছাড়াও সহশিক্ষার মতো বিষয়টিও এদেশে এখনও সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এসব কারণে হয়তো একজন ছেলের সঙ্গে একজন মেয়ের বন্ধুত্ব এখনও সে রকম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সমাজের সবার কাছে।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com