প্রযুক্তির যুগে লেখাপড়া বন্ধ রাখা সম্ভব?

শিক্ষা কী, কেন শিক্ষা এবং কীভাবে শিক্ষা? লকডাউনে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে অনেকের ধারণা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। এই যে সারাদিন সবাই বগ বগ করে দেশের স্কুল কলেজে লেখাপড়া হয় না, অকর্ম আর কুকর্মে ভরা।
তাহলে তো ভালোই যে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা কিছুটা ভালো হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সেক্ষেত্রে এ সময় অন্যভাবে শিক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন কথা রয়েছে বিশ্বজুড়ে পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র। পুঁথিগত বিদ্যা যেমন গণিত, ভূগোল, বিজ্ঞান এসব কিছু জানার জন্য গুগল যথেষ্ট নয় কি?
লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত দুর্নীতিবাজ না হয়ে সরাসরি দুর্নীতি করতে সমস্যা কোথায়? এমন একটি প্রশ্নের জবাব হচ্ছে সার্টিফিকেটধারী উচ্চশিক্ষিত না হলে বড় বড় পজিশন ধরা যাবে না। বড় বড় পজিশনে মাল কামাবার সুযোগ বেশি, তারপর ক্ষমতার একটি ব্যাপার আছে।
আকাম করলেও সহজে ধরা পড়ার সুযোগ নেই, কিন্তু কম শিক্ষা থাকলে সমাজে বড় ধরনের দুর্নীতি করা যাবে না, তারপর ধরা পড়লে ঝামেলা বেশি ইত্যাদি। তাহলে জানা গেল শিক্ষা কী এবং শিক্ষা কেন?
এবার আসা যাক সুশিক্ষা নিয়ে, এর বিশ্লেষণ কী এবং কেন সুশিক্ষা? সুশিক্ষা মানে নৈতিকতা, মানবতা, সৃজনশীলতা, বিবেকের সঙ্গে ভালো-মন্দের উপর লড়াই করা ইত্যাদি। বর্তমান সমাজে সুন্দর এবং সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকতে হলে যেসব জিনিসের দরকার তা পাওয়া কি সম্ভব হবে যদি কেউ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে জীবন যাপন করতে চায়?
এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে এর উপর প্র্যাক্টিস করতে হবে। যদি বাংলাদেশে এমন কেউ থাকেন যে এর উপর প্রাক্টিস করছেন তার থেকে এ বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করা যেতে পারে।
আমার পরবাসে চল্লিশ বছরে ইন্ডাস্ট্রি, এলিট স্পোর্টস এবং পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা থেকে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে তাতে এতটুকু বলবো যে, অন দ্য জব ট্রেনিং, ডুইং বাই লার্নিং অ্যান্ড লেসন লার্ন্ড-এর সমন্বয়ে যে শিক্ষা এটাই হচ্ছে আসল শিক্ষা বা উচিত শিক্ষা। একটি উদাহরণ তুলে ধরি আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে।
সুইডেনে অতীতে সবাইকেই বাধ্যতামূলেক মিলিটারি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হত। আমি যখন সুইডেনে আসি এটা ছিল তখন বাধ্যতামূলক। আমার জন্য শুরুতে বাধ্যতামূলক ছিল না কারণ আমি তখন গেস্ট স্টুডেন্ট। পরে যখন সুইডিশ নাগরিকত্ব হলো বয়স তখন চব্বিশ বছর। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে নোটিশ এলো মিলিটারি ট্রেনিং-এ নয় মাসের জন্য যোগদান করতে হবে।
সবে ফার্মেসিতে একজন প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢুকেছি, জীবনসঙ্গিনী যোগাড় করেছি, সবকিছু ফেলে যোগদান করতে হবে দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। কোম্পানি থেকে ছুটি মুঞ্জুর হয়ে গেল। সঙ্গিনীর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম সুইডেনের নর্থে।
মনে মনে মান্নাদের কণ্ঠের গান নিজের কণ্ঠে সুইডিশ ভাষায় প্রশ্ন করে গেলাম সঙ্গিনীকে ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো..।’ সুযোগ পেয়েছি ‘‘One of the world's toughest challenges awaits the 18 women and men who, under the leadership of four former elite soldiers, will undergo trials similar to the selection tests performed for an elite unit. The strains are enormous and few can handle it.’’
এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে ১৮ জন নারী ও পুরুষ যারা চার সাবেক অভিজাত সৈন্যের নেতৃত্বে অভিজাত ইউনিটের জন্য নির্বাচিত বাছাই পরীক্ষার অনুরূপ বিচার পাবে। চার জনের মধ্যে একজন নারী ইনস্ট্রাকটর, ভীষণ রাগী।
সারাক্ষণ তার মুখে একটি কথা “Kom inte sist” আর যাই কর সবার শেষে যেন না আসো। প্রতিযোগিতায় কাউকে তো শেষে আসতেই হবে। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কয়েকদিন পর। প্রতিযোগীদের মাঝে একদিন বলেছিলাম নারীর শরীরে ইঞ্জেকশন ঢোকেনি তাই মেজাজ সারাক্ষণ চড়া।
আমার এ কথাটি তার কানে গিয়ে পৌঁছে। আমি কি বুঝাতে চেয়েছি তিনি জানতে চাইলেন। আমি বললাম আকাশে প্রচণ্ড মেঘ অথচ বৃষ্টি নেই। উত্তরে বললো মানে? আমি বললাম যতো গর্জে ততো বর্ষে না। নারী আমার কথা বুঝতে পারেনি, আমি বললাম তোমার শরীরের হরমোনকে নিউট্রালাইজ করা দরকার নইলে তোমার মেজাজ ঠিক হবে না।
এ কথা বলার পর আমাকে গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করা হলো। বন্ধু মহলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। কথায় বলে, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না, আগে ভাগে চিন্তা না করে বলেছি, ফল হাতেনাতে, ট্রেনিং থেকে বহিষ্কার।
বাড়িতে এসে কিছুদিন পর চাকরিতে যোগদান করলাম। বছর খানেক পর খবর পেলাম ইনস্ট্রাক্টর নারী বিয়ে করেছে এবং চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। হুট করে কিছু করা বা বলা এবং এর পরিণতি কী হতে পারে এটা যদি মনে মনে একটু ভাবা হয় অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব জীবন চলার পথে।
এ ধরনের শিক্ষাকেও বলা যেতে পারে উচিত শিক্ষা। ‘‘A full is known by his speech but a wise man by silence’’ বলেছিলেন Petagoras পেথাগোরাস বেঁচে থাকলে বলতাম চুপ থেকে জ্ঞানী হবার চেয়ে বলে বোকা হওয়া অনেক শ্রেয়। সেদিনের অপ্রিয় সত্য কথার জন্য মিলিটারি ট্রেনিং শেষ করা হয়নি।
পরে সুইডিশ সরকার এটার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়। এখন ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে সুইডিশ তরুণ সমাজ মিলিটারিতে যোগদান করে। যাইহোক দুনিয়াতে যা কিছু আমাদের অজানা তা জানার সুযোগ হলে সেটা যদি শেখা হয় তার নাম শিক্ষা। যেটা আমার এবং সমাজের জন্য ভালো সেটা সুশিক্ষা আর যেটা কারও জন্য ভালো না সেটা কুশিক্ষা।
এখন বিবেকের উপর সবকিছু ন্যস্ত না করে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সিস্টেম অরিয়েন্টেড সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যদি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবে ‘‘we can get a better life to live with’’
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস