আলভীর ‘জীবন অপেরা’ গাণিতিক জীবনবোধের মানবিক আখ্যান

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী সিডনী, অস্ট্রেলিয়া
প্রকাশিত: ০৫:০৪ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২১

টানটান উত্তেজনা নিয়ে একটা উপন্যাস পড়া শেষ করলাম। নাগরিক জীবনে একটানা পড়ে কোনো বই শেষ করার মতো অবসর আমাদের নেই। কিন্তু আমি অন্তর থেকে অনুভব করছিলাম যেন বইটা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে পারি। কারণ বইটার গল্প অতিমাত্রায় গতিশীল আর পাতায় পাতায় রয়েছে উত্তেজনা। অবশ্য এ ধরনের উত্তেজনাকে আসলে কি নাম দেওয়া যায় আমার জানা। এটা কোনো রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস না আবার কোনো ভৌতিক কাহিনিও না।

একইসঙ্গে এটা কোনো ধরনের থ্রিলার না বা কোনো প্রেমের উপন্যাসও না। জ্যোতিষ শাস্ত্রের মতো বিশাল একটা বিষয়কে একেবারে জলবৎ তরলং করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসেছে আমাদের মনের ভাবনার বিভিন্ন স্তরের কথা। পাশাপাশি কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতো অত্যন্ত জটিল বিষয়কেও টেনে আনা হয়েছে বারবার।

কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিজেই যেখানে এখনও প্রতিষ্ঠিত কোনো সত্য না সেখানে শুধুমাত্র এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে একটা মাঝারি আকারের উপন্যাস লিখে ফেলা যথেষ্ট সাহসের পরিচয়। কোয়ান্টাম ফিজিক্স আসলে অনেকটা দর্শন শাস্ত্রের মতো একটা বিষয়। বিজ্ঞান যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোনো ঘটনার সত্যতা যাচাই করে দর্শন সেখানে শুধুমাত্র হাইপোথিসিস দিয়েই দায় শেষ করে।

যাইহোক উপন্যাসটা পড়তে শুরু করার পর পাঠক পুরোপুরি আটকে যাবেন বইয়ের পাতায়। মোহমুগ্ধ হয়ে পড়তে থাকবেন পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা জানার অপেক্ষায়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রফিক। বইয়ের পেছনের মলাটে যার বিষয়ে লেখা আছে, ‘সব মানুষের একটামাত্র জীবন। রফিকের জীবন দুটো।’ রফিকের এই দুই জীবনের আখ্যানই উপন্যাসের বিষয়বস্তু কিন্তু কাহিনি শুধুমাত্র রফিক এবং তার প্রেমিকা না কি স্ত্রী শারমিনকে ছাড়িয়ে ডালপালা বিস্তার করেছে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার অভ্যন্তরেও।

প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছে একজন সন্তান বড় করার প্রক্রিয়া। এসেছে আমাদের সমাজের সবচেয়ে পরিপূর্ণ সম্পর্ক বন্ধুত্বের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ও। উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে মিল রেখে প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদকে একটা করে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। এটাও উপন্যাসটার সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। মোট ষোলটি অনুচ্ছেদে লেখক কাহিনি শেষ করেছেন।

প্রথম অনুচ্ছেদ পড়ে উপন্যাসটাকে আর দশটা সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি মনে হলেও মুল কাহিনি শুরু হয়ে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে। এরপর পাঠক উপন্যাসটা শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাবেন না। অবশ্য শেষ করার পরও কি স্বস্তি পাবেন? আমি কিন্তু পাইনি। অবশ্য উপন্যাসের কাহিনি শেষ করা হয়েছে একেবারে চিরায়ত মানবিক আবেগের বহিঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে। আমরা যে জীবন যাপন করি আমরা কি সেই জীবনে সন্তুষ্ট না কি মনের কোণে আরও একটা জীবন লালন করে চলি?

এবার একটু বইয়ের ভেতরে উঁকি দেওয়া যাক। বইটার কাহিনি পরাবাস্তববাদী হলেও এর মধ্যে উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত জীবনবোধের গল্প। মধ্যবিত্ত পরিবারে সন্তানের বেড়ে ওঠা পুরোপুরিই নির্ভর করে অভিভাবকদের ইচ্ছের উপর। তাদের মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো বয়স বা সাহস কোনো সন্তানেরই থাকে না। আর থাকলেও সেই ঝুঁকি সবসময়ই সন্তানের পক্ষে নেওয়া হয়ে ওঠে না।

আর অভিভাবকেরা সন্তানের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উপরন্তু অভিভাবক যদি হন সরকারি চাকরিজীবী তাহলে তো ব্যাপারটা পুরোপুরিই একমুখী। লেখকের ভাষায়, যারা সরকারি চাকরি করেন তারা দুটো ব্যাপারে মারাত্মকভাবে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এক, কারও হুকুম তামিল করা এবং দুই, অন্যকে হুকুম দেওয়া। এর বাইরে যে অন্য একটা দুনিয়া আছে, যে দুনিয়ায় আলোচনা করে একটা জিনিসের মীমাংসা হতে পারে, সে সম্পর্কে তাদের বিশেষ ধারণা নেই।

এরপর এসেছে মানুষের স্বপ্নের কথা। লেখকের ভাষায় প্রতিটা মধ্যবিত্ত পরিবারই স্বপ্নহীন। স্বপ্ন দেখার সামান্য সুযোগ পেলেই তাদের ক্ষুধা বেড়ে যায়। এরপর জোতিষ শাস্ত্রের পরিধি বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে, প্রকৃতির সবকিছুই অংকের নিয়মে চলে। এখন সেই অংকটা যদি কেউ কষতে জানে, তার পক্ষে মানুষের ভবিষ্যৎ বলা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

এরপর নিউমারলজি এবং প্যারালাল ইউনিভার্সের সম্মন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নিউমারলজির বিষয়টা একেবারে হাতেকলমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে পাঠককে থেমে যেতে না হয়। প্যারালাল ইউনিভার্সের বিষয়েও দুটো ঘটনার বিষদ বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে অংক শাস্ত্র এবং পদার্থবিদ্যার এমন সব জটিল বিষয়কে আশ্রয় করে কাহিনি এগিয়েছে যে সেগুলোর ব্যাখ্যা না দিলে পাঠক উপন্যাসের রস আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হতেন।

এছাড়াও মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্বর সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। কিভাবে এক স্তর থেকে মানুষ অন্য স্তরে যেতে পারে সেই বিষয়েও বিস্তারিত বলা হয়েছে। এসব খটমটে বিষয়ের আলোচনা করতে গিয়ে লেখক কখনও কাহিনির মানবীয় দিক থেকে সরে আসেননি। বরং মানব জীবনের সঙ্গে এগুলোকে রিলেট করে কাহিনিকে দিয়েছেন অন্যমাত্রা। গ্রিক ট্রাজেডিগুলোর উল্লেখ করে বলা হয়েছে ‘দুঃখটাই মানুষের নিয়তি। সুখী হওয়ার কোন উপায় নেই। যতই পালাতে চাও, পারবে না। ''Mortal fate is hard. You'd best get uaed to it.'' আমাদের জীবনে মানুষকে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা সোজা না।

লেখকের ভাষায়, ‘যারা পারে, তারা ভাগ্যবান।’ এছাড়াও মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার সবচেয়ে বড় অসুবিধা বা সত্যটার কথাও বলা হয়েছে। লেখকের ভাষায়, ‘মানুষ যত কিছুই করুক না কেন, ক্ষুধাকে জয় করতে পারেনি।’

উপন্যাসের চালিকাশক্তি একটা ডায়েরি অথবা নোটবুক। ফরাসী কবি চার্লস বোদলেয়ারের একটা নোটবুক ছিলো সেখানে তিনি কবিতা আকারে লিখে রাখতেন তার আশ্চর্য দিনলিপি। সেই নোটবুক পরে বিখ্যাত হয় জুনো আঁতিম নামে। যার বাংলা হতে পারে ‘অন্তরঙ্গ দিনলিপি’। কিন্তু সেটা একটু সেকেলে শোনায়। তাই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রফিক তার নোটবুকের না দিয়েছে ‘জীবন অপেরা’।

এই উপন্যাসটা পড়ার পর একটা বিষয় সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সেটা হলো মানব জীবন সম্মন্ধে লেখকের অন্তর্দৃষ্টি। লেখক পরম মমতায় এক একটা চরিত্র বিনির্মাণ করেছেন। কোথাও কোনো খুঁত রাখেননি। হয়তোবা প্রথম উপন্যাস বলেই লেখক তার মেধার পূর্ণ ব্যবহার করেছেন এটা রচনা করতে গিয়ে। লেখকের কাছ থেকে এমন আরও অনেক লেখা পড়ার আগ্রহ তৈরি হয় উপন্যাসটা শেষ করার পর। লেখক হিসেবে সার্থকতা হয়তোবা এখানেই।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]