শেষ চিঠি: সন্তানহারা মায়ের আহাজারি

পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ শব্দ মা। মা ডাকতে পারলেই মনের মধ্যে একটা শীতল হাওয়া বয়ে যায়। মনটা শান্ত হয়। মনের শক্তি বেড়ে যায়। মা’ই একমাত্র কোনোপ্রকার বাদানুবাদ ছাড়া সব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। মা’ই তার সন্তানকে সবচেয়ে ভালো বোঝে। মা নিজের সন্তানের জন্য নিজের প্রাণের মায়া পর্যন্ত করেন না।
এমন উদাহরণ অনেক আছে পৃথিবীর বুকে। হুমায়ূন আহমেদের মা’ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই হুমায়ূন আহমেদকে হারিয়ে এই মা’ও ভীষণ মুষড়ে পড়ছিলেন। তারপর হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। অনেকটা স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে নিজের অকালপ্রয়াত সন্তানের সঙ্গে কথা বলেছেন এই লেখার মাধ্যমে।
এই লেখা বিষয়ে বইয়ের ভূমিকায় সুফিয়া হায়দার লিখেছেন, আমাদের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ মারা যাওয়ার পর আমাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সব সময় অস্থির থাকতেন। কী করলে একটু ভালো থাকবেন, আমরা ভেবে পেতাম না। হঠাৎ একদিন দেখি একটি ছোট রুলটানা খাতায় গুটি গুটি করে মা কী যেন লিখছেন। সবাই খুব অবাক হলাম। এ রকম মানসিক অবস্থায় মা কী লিখছেন? মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি তোদের দাদাভাই এর সঙ্গে কথা বলি।’ মা লিখে লিখে তার আদরের ছেলের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলতেন।’
সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার তো কোনো সিলেবাস নেই যে তাকে কোনো একটা নিয়মে ফেলা যাবে। তাই এই বইয়ে মা একমনে লিখে চলেছেন নিজের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবগুলো। আর সেটা করতে গিয়ে অনেক বিষয়ই একাধিকবার এসেছে। লেখার মধ্যে ধারাবাহিকতা নেই।
সময়ের হিসাবও ঠিক নেই। অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তুর সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা লিখেছেন। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয় একজন মা তার বুকের সবচেয়ে বড় ধন সন্তানকে হারিয়েও কারো প্রতি বিষোদগার করেননি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়েছেন তার সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য। তার সন্তানকে অকৃত্রিম ভালোবাসা দেওয়ার জন্য।
এই বইয়ের প্রত্যেকটা লাইনে প্রকাশ পেয়েছে একজন সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা। এই বই পড়তে পড়তে কখন যে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে পাঠকই টেরই পাবেন না। আসলেই আমাদের মায়েরা তো এমনই। বলা হয়ে থাকে বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারি। এই বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যুও অনেক বেশি কষ্টের।
বইটার প্রথম লাইনটা এমন, আমার এত আদরের বাচ্চাটি আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে?’ সন্তানহারা মায়েরা যুগে যুগে ঠিক এভাবেই প্রশ্ন করে গেছেন যদিও জানেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তার সন্তান আর ফিরে আসবে না।
এরপর মা আবার লিখেছেন, বাবা, তোমার কি একবারও মনে হয় নাই যে তোমার একটা দুঃখী মা আছে, একটা সুন্দর দেশ আছে, তোমার ভাই-বোনগুলো তোমার আশায় অপেক্ষা করছে। দেশের মানুষ তোমাকে কী-ই না ভালোবাসে৷’
সন্তানের সঙ্গে মায়ের নাড়িছেঁড়া বন্ধন তাইতো মা তার সন্তানকে ফিরে পেতে চান যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। এমনকি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও চান যেন তার সন্তান নতুন জীবন পায়।
বইয়ের ভাষায়, বাবা, মৃত্যুর জন্য কতকাল থেকে আমি অপেক্ষা করে আছি। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যত খতম আছে সব পড়েছি। প্রথম দিন থেকে ছদকা দিয়েছি। ছাগল দিয়েছি, গরু দিয়েছি, মুরগী তো প্রায়ই দিতাম। সাতটা সুস্থ সবল মুরগী দিয়েছি একসাথে। শুনেছি একসাথে সাতটা সদকা দিলে আল্লাহ দয়া করেন। তোমার যখন অপারেশন হচ্ছে তখন আমি এক বৈঠকে ১০৪ রাকাত নামাজ আদায় করেছি।’
সন্তানের অন্তিম সময়ে মা ঠিকই টের পেয়ে যান যে তার সন্তানের অমঙ্গল হতে চলেছে। বইয়ের ভাষায়, একদিকে মা, অন্যদিকে ছেলে, মাঝখানে একটা পৃথিবী, এর থেকে বড় কষ্ট বুঝি আর কিছু নাই। কিন্তু যেদিন তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে সেদিন দেখি আমি কিছুতেই শান্তি পাই না। আমার জ্ঞান আছে, আমি বুঝতে পারছি, বাবা, এই হচ্ছে তোমার চিরবিদায়।’
সন্তানের মৃত্যুর পর মায়ের মনে অনেক ধরনের চিন্তার উদ্রেক ঘটেছে। কখনও মনে হয়েছে আমার আদরের সন্তান কি আমার উপর রাগ করেছিল? আবার কখনও ফুটে উঠেছে সন্তানের শেষ সময়ে তার পাশে না থাকার আক্ষেপ। বইয়ের ভাষায়, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাবা, তুমি কি আমার উপর রাগ করে গিয়েছো? তোমাকে একবারও স্বপ্নে দেখি না কেন?
আমি যদি তোমার ওপর কোনো অন্যায় করে থাকি সেটা না জেনে করেছি। না বুঝে করেছি। তুমি আমার ওপর রাগ করে থেকো না বাবা। আমি বেঁচে থেকেও আমার অসুস্থ ছেলেটিকে গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম না। কী খায় দেখলাম না। কেমো নিয়ে অসুস্থ শরীরে কীভাবে চলাফেরা করে, কিছুই দেখলাম না।’
সন্তান হারানোর পর মায়ের মনে কতশত সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়। মনে হয় এটা করলে হয়তোবা তার সন্তান বেঁচে থাকতো। সেটা করলে হয়তোবা তার সন্তান সুস্থ হয়ে উঠতো। ছোট বেলায় একবার হুমায়ূন আহমেদ শখ করে রোজা রেখেছিলেন কিন্তু বেলা তিনটার দিয়ে তার খিদে পেয়ে গেলো। তখন মায়ের কাছে এসে বললেন, আপনি আমাকে কেন রোজা রাখতে দিলেন?
তার উত্তরে মা বলেছিলেন তুমিই তো রোজা রাখতে চাইলে! উত্তর ছেলে বলেছিলেন, আমি চাইলেই আপনি রাখতে দেবেন কেন? ছেলের চিকিৎসার বিষয়টা নিয়েও তাই মায়ের মনে প্রশ্ন উঠেছিল। বইয়ের ভাষায়, আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছিল, সিঙ্গাপুর ছিল, অথচ তুমি গেলে আমেরিকায়। আমি কেন তোমাকে যেতে দিলাম? তুমি কি সেই ছোটবেলার মতো আমাকে বলতে চেয়েছিলে, আমি না-হয় যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি কেন আমাকে যেতে দিলেন?’
সন্তান মারা যাওয়ার পর মায়ের মনের পর্দায় বারবার ভেসে উঠছে সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে পুরো জীবনের ছবি। বইয়ের ভাষায়, তোমার জন্মের পর একটা খুশির বন্যায় ভেসে গেছি। আমাদের পূর্বপুরুষের আমলে যত মালী, তেলী, ধোপা, নাপিত থাকত পরিবারে কোনো সন্তান হলে তারা এসে নাচ-গান করে বকশিস নিত। তোমার জন্মের সময়ও তাই হলো।’
অকালপ্রয়াত সন্তানের সকল স্মৃতি মায়ের মনে উঁকি দিয়েছে একে একে, তোমার বাবার সঙ্গে তোমার বিচিত্র স্বভাবের কথা নিয়ে আলাপ করতাম। বলতাম, ‘তোমার ছেলেটা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে?’ তোমার বাবা বলত, জানো প্রমথনাথ বিশীও এমন করে ঘুরে বেড়াতেন, বিখ্যাত একজন লেখক। তোমার ছেলে নিশ্চয় বিখ্যাত লেখক হবে।’
সন্তানের মৃত্যুর পরও মা চেয়েছিলেন সন্তানের কাছাকাছি থাকতে। তাই কল্পনা করেছিলেন তার আদরের সন্তান হুমায়ূনের কবরটা কেমন হতে পারে, সম্রাট হুমায়ূনের কবর কেমন হবে সেটা কল্পনা করার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু আমার হুমায়ূনের সমাধিটা কেমন হবে সে রকম একটা কল্পনা আমার ছিল।
সমান মাটির মাঝে কবরটা একটুখানি উঁচু আর পুরো জায়গাটা সবুজ ঘাস দিয়ে গালিচার মতো ঢাকা। আমি কাছে বসে কবরটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকতাম আর বলতাম, আমার বাবাটা ঘুমিয়ে আছে। আমার আদরের মানিক শান্ত হয়ে শুয়ে আছে।’
সন্তান মারা যাওয়ার পরও মা মনে মনে সেটা মেনে নিতে পারেননি। তার মনে হয়েছে তার ছেলে তার আঁচলের ছায়া তলেই আছে। বইয়ের ভাষায়, তোমার শেষ কবিতায় তুমি লিখেছিলে লিলুয়া হাওয়া নাচে-কবিতার শেষ লাইনটা লেখার জন্য কাগজ নেই, তুমি ছটফট করছ। আমি আমার সাদা শাড়ির আঁচলটা বিছায়ে দিলাম, তুমি সেখানে লিখে রাখলে।’
সন্তান ছাড়া মায়ের বেঁচে থাকা সত্যিই অনেক কষ্টের। এই বইয়ের প্রত্যেকটা পাতায় সেই বিষাদের ছায়াও আছে। বইটা শেষ করা হয়েছে এভাবে, এখন আমি লিখতে বসেছি। লিখে যাচ্ছি, শুধু তোমাকে লিখে যাচ্ছি। আহা রে! যদি এটা সত্যি হতো আসলেই তোমাকে আমি লিখতে পারতাম, তাহলে এই পৃথিবীতে আমার তো এর চাইতে বড় কিছু চাওয়ার ছিলো না। আহা! কেন এটা সত্যি হয় না?’
আর বইয়ের শেষ লাইনটা পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো জলে ভরে উঠে। একটা লাইন দিয়ে সন্তানহারা মায়ের দুঃখের বোঝা কত ভারি সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘বেঁচে থাকা বড় কষ্ট বাবা। বড় কষ্ট।’
এমআরএম/জিকেএস