কোরবানির পশু ক্রয়ে ইসলামের নির্দেশনা
মোহাম্মদ হাসিব উল্লাহ
কোরবানি। বান্দা কর্তৃক মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন ও আত্মত্যাগের অনন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ঈদুল আজহার দিন হতে অর্থাৎ ১০ জিলহজ তারিখ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানির দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু জবাই করাই হচ্ছে কোরবানি। শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কোরবানি করে না, তাদের ব্যাপারে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কঠোরতা গ্রহণ করেছেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا
‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে।’ (ইবনে মাজাহ ৩১২৩)
তবে কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য সঠিক পশু নির্বাচন করা জরুরি। হাদিসের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী দোষ-ত্রুটিমুক্ত পশু ক্রয় করা সবার জন্য আবশ্যক। কেননা কোরবানির পশুর মাঝে নির্দিষ্ট গুণাবলী থাকা ও বয়সের হওয়া আবশ্যক। যা ইসলামি শরিয়াহ নির্ধারণ করেছে। নতুবা কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না।
১. পশুর বয়স হওয়া
শরিয়তের বিধান মতে, ‘গৃহপালিত জন্তু যথাক্রমে উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা বৈধ।’ এগুলো ছাড়া অন্য পশু দ্বারা কোরবানি বৈধ নয়। কোনো প্রকার পাখি দ্বারা কোরবানি করা জায়েয নেই। (হেদায়া ৪/৪৩২)
গৃহপালিত আলোচ্য পশুগুলোকে কোরআনের ভাষায় ‘বাহিমাতুল ও বাহিমাতিল আনআম’ (بَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ) বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে শব্দগুলো তিন জায়গায় যথাক্রমে সুরা মায়েদার ১নং আয়াতে এবং সুরা হজের ২৮ ও ৩৪নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
কোরবানির ক্ষেত্রে পশু পরিপূর্ণ বয়সের হতে হবে। অর্থাৎ পশুর নির্দিষ্ট বয়স না হলে কোরবানি আদায় হবে না। এক্ষেত্রে উট পাঁচ বছর বয়সের হতে হবে। গরু ও মহিষ দুই বছর হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত। একদিন কম হলেও বৈধ হবে না। (কেফায়াতুল মুফতি ৮/১৮৯)
তবে ফতোয়ার গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘ছয় মাসের ভেড়া, দুম্বা মোটাতাজা হলে এবং দেখতে এক বছর বয়সের ন্যায় দেখা গেলে, এসব পশু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ।’
২. চোখ-কান ঠিক থাকা
যে পশু দিয়ে কোরবানি করা হবে, শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী সে পশুর চোখ, কান ও লেজ ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। যেমন-
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা:) আমাদের আদেশ করেছেন-
أَنْ نَسْتَشْرِفَ الْعَيْنَ، وَالْأُذُنَ، وَأَنْ لَا نُضَحِّيَ بِمُقَابَلَةٍ، وَلَا مُدَابَرَةٍ، وَلَا بَتْرَاءَ، وَلَا خَرْقَاءَ،
‘আমরা যেন কোরবানির পশুর চোখ ও কান উত্তমরূপে দেখে নেই। আর আমরা যেন কানের অগ্রভাগ কাটা, কানের পেছন দিক কাটা, লেজ কাটা এবং কানের গোড়া থেকে কাটা পশু কোরবানি না করি।’ (নাসাঈ ৪৩৭২)
ফতোয়ার গ্রন্থে এসেছে, কান এবং লেজ অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি কাটা হলে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না। এমনকি উভয় কানের কাটা অংশ যোগ করলে এক কানের অর্ধেক পরিমাণ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তাহলে এ পশু দ্বারা কোরবানি না করাই উত্তম। করলে কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। (আহকামে কোরবানি, পৃষ্ঠা ১৬)
৩. ত্রুটিমুক্ত হওয়া
এছাড়াও কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে পশু দোষ-ত্রুটিমুক্ত হওয়া আবশ্যক। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিপূর্ণ সুস্থ ও দোষমুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
أَرْبَعٌ لاَ تَجُوزُ فِي الأَضَاحِي الْعَوْرَاءُ بَيِّنٌ عَوَرُهَا وَالْمَرِيضَةُ بَيِّنٌ مَرَضُهَا وَالْعَرْجَاءُ بَيِّنٌ ظَلْعُهَا وَالْكَسِيرُ الَّتِي لاَ تَنْقَى
‘চার ধরনের দোষযুক্ত পশু কোরবানি করা বৈধ নয়। যথাক্রমে- অন্ধ, যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট; রুগ্ন, যার রোগ সুস্পষ্ট; খোঁড়া, যার খোঁড়ামী সুস্পষ্ট; বৃদ্ধ ও দুর্বল, যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে।’ (আবু দাউদ ২৮০২)
৪. দাঁত ও শিং থাকা
পশুর যদি এমন পরিমাণ দাঁত থাকে যা দিয়ে ঘাঁস খেতে পারে, তাহলে কোরবানি বৈধ হবে। আর যদি ঘাস খেতে না পারে, তাহলে কোরবানি বৈধ হবে না। চাই দাঁত বেশি থাকুক, আর কম থাকুক।’ (আহসানুল ফাতওয়া ৭/৫১৪-৫১৫)
তবে কোনো পশুর শিং যদি মূল থেকে ভেঙ্গে যায়, তাহলে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না। কেননা ইয়াযিদ মিসরি রাহিমাহুল্লাহু থেকে বর্ণিত-
إِنَّمَا نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْمُصْفَرَّةِ وَالْمُسْتَأْصَلَةِ وَالْبَخْقَاءِ وَالْمُشَيَّعَةِ وَالْكَسْرَاءِ
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কানকাটা, শিংবিহীন, অন্ধ, দুর্বল এবং পা ভাঙ্গা পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন।’ (আবু দাউদ ২৮০৩)
পাশাপাশি, ছাগলের জিহ্বা যদি এ পরিমাণ কাটা হয় যার ফলে ঘাঁস ইত্যাদি খেতে অসুবিধা হয়, তাহলে এ ধরনের ছাগল দ্বারা কোরবানি করা বৈধ হবে না। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী ৫/২৯৮)
৫. পাগল পশু
পাগল পশু দ্বারা কোরবানি জায়েয। তবে পশু যদি মাঠে না চড়ে এবং ঘাস ইত্যাদি খাওয়ার প্রতিবন্ধক হয় তাহলে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী ৫/২৯৮)
৬. গর্ভবতী পশু
গর্ভবতী পশু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের সময় আসন্ন হলে, গর্ভবতী পশু কোরবানি করা মাকরুহ। এছাড়া পশু কোরবানি করার পরে যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায়, তাহলে ঐ বাচ্চাও কোরবানি করতে হবে এবং গোশত খাওয়া বৈধ হবে। (ইসলামে কোরবানি ও আকিকার বিধান, পৃষ্ঠা ৭৫)
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, কোরবানি করার ক্ষেত্রে পশু দোষ-ত্রুটিমুক্ত হওয়া আবশ্যক এবং এক্ষেত্রে সবার সচেষ্ট থাকা উচিত। কেননা কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে শুধুমাত্র বান্দার তাকওয়া পৌঁছে, ভিন্ন কিছু নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَنۡ یَّنَالَ اللّٰه لُحُوۡمُها وَ لَا دِمَآؤُہَا وَلٰکِنۡ یَّنَالُه التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡ
‘তোমাদের কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: আয়াত ৩৭)
লেখক: তরুণ গবেষক।
এমএমএস/এএসএম